দেবাদিদেব মহাদেব এবং শ্রী বিষ্ণু- এই দুই দেবতাকে উৎসর্গ না করলে কোনও পূজা সম্পূর্ণ হয় না। আবার জগতের অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্বও মূলত এঁদেরই উপর বর্তায়। কিন্তু দুই দেবতার ক্ষেত্রে মিল নেই তাঁদের পুজোর উপকরণে। বিশেষত নারায়ণ পুজো যে তুলসী পাতা ছাড়া অসম্ভব, মহেশ্বরের পুজোয় সেই তুলসী নাকি নিষিদ্ধ। কী এমন কারণ রয়েছে এর নেপথ্যে? আসুন, শুনে নিই।
মহাদেব যেমন সন্তুষ্ট হন বেলপাতায়। তেমনই শ্রীবিষ্ণুর পুজোয় আবশ্যক তুলসী পাতা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই তুলসীপাতা একেবারেই নিষিদ্ধ মহাদেবের পুজোয়।
আরও শুনুন: অভিশাপে পাথর হয়েছিলেন স্বয়ং নারায়ণ, সেই কারণেই কি পূজা হয় শালগ্রাম শিলার?
পুরাণের গল্পে বিভিন্ন জায়গাতেই উল্লেখ পাওয়া যায় ‘হরি-হর’ শব্দটির। প্রচলিত বাগধারায় কাছের দুই মানুষকে বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই শব্দটিই। যার উৎপত্তি ত্রিদেবের অন্যতম দুই দেবতা, শ্রীবিষ্ণু এবং মহাদেবকে বোঝাতে। বলা হয় তাঁরা নাকি একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু দুই দেবতার মধ্যে এমন মিল থাকলেও তাঁদের পুজোর কিছু উপকরণ একেবারেই মেলে না। বরং সেই বিশেষ কিছু উপাদান একজনের প্রিয় তো অন্যজনের পুজোয় নিষিদ্ধ। তেমনই এক উপাদান হলো তুলসী পাতা। কিন্তু এই তুলসী পাতা বিষ্ণুপূজায় আবশ্যিক হলেও মহাদেবের পুজোয় একেবারেই নিষিদ্ধ। যার নেপথ্যে রয়েছে এক প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনিই।
মূলত পদ্মপুরাণে কথিত জলন্ধর অসুর বধের কাহিনিটি থেকে বিষ্ণু পূজায় তুলসীর আবশ্যিকতার কারণ আন্দাজ করা যেতে পারে। বলা হয় পুরাকালে জলন্ধর নামে এক ভয়ঙ্কর অসুর ছিল। তবে এই নাম নিয়ে পুরাণভেদে মতপার্থক্য রয়েছে। পুরাণভেদে জলন্ধরকে শঙ্খচূড় হিসেবেও পাওয়া গিয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই অন্যান্য অসুরদের মতোই তপস্যার জোরে তিনি অতুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। আর ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে তিনিও দেবতাদের ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁকে বধ করার উপায় ছিল না কোনও দেবতার কাছেই। কারণ তাঁর প্রাণভোমরা থাকতো তাঁর স্ত্রী বৃন্দার কাছে। শোনা যায়, এই বৃন্দা নাকি ছিলেন পরম সতী সাধ্বী এক নারী। জলন্ধরের বরটিও ছিল এই বৃন্দার সতীত্বের উপর ভিত্তি করেই। বরদানের সময় স্বয়ং ব্রহ্মা জলন্ধরকে বলেছিলেন কখনও যদি জলন্ধর ব্যতীত অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে বৃন্দা শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন তাহলেই জলন্ধরের হত্যা সম্ভব। সেই বরের জোরেই ত্রিভুবন জুড়ে ভয়ানক অত্যাচার শুরু করে জলন্ধর। অবস্থা বেগতিক দেখে যথারীতি মহাদেবের শরণাপন্ন হন। দেবাদিদেব জলন্ধরের বরপ্রাপ্তির কথা জানতেন। তিনি দেবগণকে আশ্বস্ত করে বলেন জলন্ধরের বধ তাঁর হাতেই হবে, কিন্তু তার জন্য শ্রীবিষ্ণুর মায়ার সাহায্য নিতে হবে। তাই মহেশ্বরের পরামর্শ মতো দেবগণ হাজির হন বৈকুন্ঠ্যে। তাঁদের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে নারায়ণ এক অদ্ভুত ফন্দি বার করেন। দেবতাদের তিনি নির্দেশ দেন জলন্ধরকে যুদ্ধে আহ্বান জানানোর জন্য এবং দেবতারা যেন যে কোনও উপায়ে জলন্ধরকে অন্তত একরাতের জন্য পাতালপুরির বাইরে ব্যস্ত রাখেন। সেই মতো দেবতারাও জলন্ধরকে উত্যক্ত্য করতে আরম্ভ করেন। বিরক্ত হয়ে জলন্ধর নিজের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেই নারায়ণ স্বয়ং জলন্ধরের ছদ্মবেশ ধরে বৃন্দার সামনে হাজির হন। অন্যান্য দিনের মতোই সমস্ত কাজ সেরে বৃন্দাও স্বামীর কাছে ফিরে আসেন। স্বাভাবিক অভ্যাসে তাঁরা মিলিতও হন। কিন্তু কিছুক্ষণ কাটানোর পরই বৃন্দা বুঝতে পারেন তাঁর স্বামীর দেহে অদ্ভুত সুন্দর এক ফুলের সুবাস রয়েছে। তখনই স্বামীরূপে অন্য কারও সঙ্গে তিনি মিলিত হয়েছেন বুঝতে পেরে যান। এরপরই স্বমূর্তিতে প্রকট হন নারায়ণ। তাঁকে দেখেই কান্নায় লুটিয়ে পড়েন বৃন্দা। এবং ক্রোধের বশে স্বয়ং শ্রীহরিকেই পাথর হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন। অন্যদিকে বৃন্দার চরিত্র হনন হতেই মহাদেবের নিক্ষেপ করা ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান জলন্ধর।
আরও শুনুন: পুরাণে ছিল বৃক্ষের উল্লেখ, আধুনিক কালে স্বয়ং ‘কল্পতরু’ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
তুলসীর জন্ম এখান থেকেই। কথিত আছে, জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা নিজেই ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। তাই তাঁর কাছ থেকে অভিশাপ পেয়েও তাঁকে একটি বর দেন শ্রীবিষ্ণু। তিনি বলেন বৃন্দার অভিশাপে নারায়ণ যেমন শিলাখণ্ডে পরিণত হবেন তেমনই বৃন্দার শরীর থেকেই জন্ম নেবে এক বিশেষ গাছ। নারায়ণ যার নাম দেন ‘তুলসী’। এবং তিনিই বলেন নারায়ণ পুজোয় আবশ্যিক ভাবে লাগবে এই তুলসী গাছের পাতা। সেই থেকেই মর্ত্যে নারায়ণ হিসেবে শালগ্রাম শিলার পুজোর প্রচলন শুরু হয়। এবং তাঁর সঙ্গে শালগ্রাম শিলা পূজায় আবশ্যিক হয়ে যায় তুলসী পাতা নিবেদন। অন্যদিকে মহাদেবের হাতেই জলন্ধরের মৃত্যু হয়েছিল বলে তাঁর পুজোয় কোনওভাবেই ব্যবহৃত হয় না বৃন্দার অংশ তুলসীর।