পুরীতে তিনটি আলাদা রথে চড়ে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। কিন্তু যাত্রা শেষ হলে তিনটি রথই ভেঙে ফেলা হয়। বছর বছর রথ তৈরির এত কাঠ আসে কোথা থেকে? পুরনো রথের কাঠগুলোরই বা কী হয়? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
রথযাত্রা ভারতের প্রাচীন উৎসব। শুধুমাত্র হিন্দু নয়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও রথযাত্রার প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সে উল্লেখ মেলে। তবে গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড় রথযাত্রা পালিত হয় পুরীতে। মহাপ্রভু জগন্নাথের রথ। আলাদা তিনটি রথে নগর পরিক্রমায় বেরোন ত্রিমূর্তি। তিনটি রথেরই আয়ু রথযাত্রা অবধি। জগন্নাথ পুরীর মন্দিরে ফিরে এলেই ভেঙে ফেলা হয় রথগুলি।
আরও শুনুন: মাসি নন পৌর্ণমাসী! কেন তাঁর কাছেই রথে চেপে যান জগন্নাথ?
পুরীতে রথের প্রস্তুতি শুরু হয় পাঁচ মাস আগে থেকে। মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমীতে কাঠ সংগ্রহ দিয়ে শুরু হয় সেই কাজ। রথ তৈরি শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার জন্য তিনটি আলাদা রথ। সবকটির উচ্চতা ও চাকার মাপ আলাদা। রথগুলোর মাঝ বরাবর তৈরি হয় মণ্ডপ ও বেদি। আর সেখানেই অবস্থান করেন মহাপ্রভু। মণ্ডপের চারদিকে থাকে চারটি তোরণ। বিভিন্ন রঙিন ছবি, অলংকার ও পুতুল দিয়ে সজ্জিত থাকে তিনটি রথ। পট্টবস্ত্র দিয়ে সাজানো হয় রথগুলো। আর সবকটির উপরই থাকে ধ্বজা। সম্পূর্ণ রথ, যাত্রার কয়েকদিন আগেই তৈরি হয়ে যায়। কদিন ধরে প্রভুর মতো বিশেষ মর্যাদা পায় তিনটি রথ। কেউ রথের রশিতে মাথা ঠেকিয়ে নিজেকে ধন্য করেন, কেউ আবার রথ স্পর্শ করে পাপের বোঝা কমান। রথ তৈরির প্রক্রিয়াও নেহাতই সহজ নয়। খরচ হয় কোটি টাকা। সেইসঙ্গে অন্তত জনা পঞ্চাশ সেবায়েতের দিবা-রাত্র পরিশ্রম। জানা যায়, এই রথে কোনও লোহার পেরেক থাকে না। এমনকি হাতুড়িও ব্যবহার করা হয় কাঠের। তবে এত পরিশ্রম খরচের আয়ু মাত্র কয়েকদিন। উলটোরথে জগন্নাথকে নিয়ে শ্রী মন্দিরে ফিরে এলেই রথ ভাঙার কাজ শুরু হয়ে যায়। তখনও অবশ্য যেমন তেমন করে ভাঙা হয় না। ভক্তিভরে রথের প্রতিটি অংশ আলাদা করে ফেলা হয়। সবার আগে প্রতিটি চাকার কাঠ বিলি করে দেওয়া হয় ভক্তদের মধ্যে। স্থানীয়রা মনে করেন রথের চাকার অংশ বাড়িতে রাখা অত্যন্ত শুভ। তবে রথের বাকি অংশ চলে যায় জগন্নাথের ভোগের ঘরে। সেখানে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় কাঠগুলি। আসলে, জগন্নাথের ভোগ সম্পূর্ণ কাঠের জ্বালে রান্না হয়। সেখানে প্রতিদিন কয়েক মণ কাঠ প্রয়োজন। রথযাত্রার পরের কদিন সেই চাহিদা মেটায় জগন্নাথের রথের কাঠই।
আরও শুনুন: জগন্নাথ পুজোয় কাটে গ্রহের দোষ! বিগ্রহেই রয়েছে নবগ্রহের সন্নিবেশ
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতি বছর রথ তৈরির এত কাঠ আসে কোথা থেকে?
মন্দিরের নিয়ম অনুসারে, রথ তৈরিতে যে কাঠ ব্যবহার করা হয়, তার উত্স পুরীর কাছে দাশপাল্লা ও রাণাপুর নামে দুটি সংরক্ষিত জঙ্গল। প্রতিবছর রথের জন্য এই জঙ্গল থেকেই কাঠ সংগ্রহ করা হয়। মূলত নিমকাঠ ব্যবহার করা হয় রথ তৈরিতে। সেই হিসাবে এই দুই জংগলে প্রচুর নিমগাছ রয়েছে। কিন্তু বছর বছর এত কাঠ নিয়ে গেলে একদিন গোটা জঙ্গলটাই ফাঁকা হয়ে যাবে। তাই প্রতি বছর যে পরিমাণ কাঠ কাটা হয়, তার দ্বিগুণ গাছ রোপণ করা হয়। তাতে কোনওদিন গাছের অভাব পড়ে না। তাই প্রতি বছর প্রভুর রথ তৈরির জন্য এই জঙ্গল থেকেই নিয়ে আসা হয় কাঠ।