গুরুদায়িত্ব। প্রতিদিন বদলাতে হবে শ্রীমন্দিরের ধ্বজা। উচ্চতা প্রায় ২১৪ ফুট। সিঁড়ি নেই। সঙ্গে আছে গুরুমন্ত্র। মাতা বিমলা দেবীর আশীর্বাদ। সেই সম্বলেই অকুতোভয় নৃসিংহ মহাপাত্র। জগন্নাথের ধ্বজা যিনি উড়িয়ে দেন, জগতের উদ্দেশে তাঁর কী বার্তা?
সেই অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি মুখোমুখি বসে শুনলেন শুভদীপ রায়।
সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। বৃষ্টি থামছেই না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মন্দিরে ভিড় তেমন নেই। তবে গর্ভগৃহের সব কাজ নিয়মমাফিক হয়ে চলেছে। যথাসময়ে আহার সেরেছেন প্রভু জগন্নাথ। ভোগ পেয়েছেন ভক্তরা। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সবকিছু চলছে। এবার পালা ধ্বজা পরিবর্তনের। মন্দিরের চূড়ায় উঠে বদলাতে হবে মন্দিরের ধ্বজা।
সহজ কাজ নয়, কারণ চূড়ায় ওঠার আলাদা কোনও সিঁড়ি নেই। মন্দিরের গায়ে থাকা খাঁজে শরীরে ভার রেখে কৌশলে উপরে উঠতে হয়। তাও আবার পিছন ফিরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে উপরে ওঠা নিয়ম। অন্যান্য দিনে তাও মানা যায়, কিন্তু এই ঘোর বাদলের দিনে এই কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। পাথরের খাঁজে জল পড়ে পিচ্ছিল হতে পারে, বিপদের সম্ভাবনা থাকেই। তবে কি নিয়ম বদলাবে? প্রশ্নই ওঠে না। নিয়ম বলছে, একদিন ধ্বজা পরিবর্তন না হলে আগামী ১৩ বছরের জন্য বন্ধ হবে শ্রীমন্দিরের দরজা। তবে স্রেফ নিয়মের ভয়ে নয়, ভালোবাসা আর প্রভুর সেবায় নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিতেই ঝড় জল মাথায় নিয়ে মন্দিরের চূড়ায় ওঠেন নৃসিংহ মহাপাত্র।
মাত্র ৮ বছর বয়সে প্রথমবার মন্দিরের চূড়ায় উঠেছিলেন। এরপর কেটেছে বছর পঁচিশ, একদিনের জন্যও নিয়ম বদলায়নি। হ্যাঁ, শরীর খারাপ হলে অন্য কেউ দায়িত্ব সামলেছে, তবে সুস্থ রয়েছেন তাও মন্দিরের চূড়ায় ওঠেননি এমন একটা দিনের কথাও মনে করতে পারলেন না নৃসিংহ। ছিপছিপে চেহারা নয় মোটেও, বলিষ্ঠ চেহারার মাঝবয়সী যুবকের চোখে-মুখে প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট। অথচ যে সময় তাঁর সঙ্গে দেখা, তার কিছুক্ষণ আগেই ২১৪ ফুট উচ্চতা থেকে নেমেছেন। খালি পা, পরনে খাটো ধুতি, কাঁধে চাদর, গলায় তুলসী কাঠের মালা। নামার সময় সঙ্গে এনেছেন আগের দিনের সমস্ত ধ্বজা। সেইসব নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে ইচ্ছুক ভক্তদের বিলিয়ে দিচ্ছেন। তিনি একা নন অবশ্য। চূড়ায় উঠেছিলেন আরও কয়েকজন। তাঁদের কাজ ছোট ছোট পতাকাগুলি নামিয়ে আনতে সাহায্য করা। তবে মূল ধ্বজা অর্থাৎ শ্রী মন্দিরের চূড়ায় যে চক্র তার উপরে থাকা পতাকাটি বদলানোর দায়িত্ব একা নৃসিংহের। বাকিরা তার খানিকটা নিচ থেকেই ফিরে আসেন।
নৃসিংহ তরতরিয়ে চড়েন চক্রের উপর। বিশেষ কায়দায় নিজেকে আটকে রাখেন, দূর থেকে দেখে যে কারও ভয় লাগতে বাধ্য। অথচ নৃসিংহের দাবি, এতটুকু ভয় লাগে না। তাঁর কথা, ভয়ের লেশমাত্র মনে জন্মই নেয় না। সারাক্ষণ প্রভুর নাম স্মরণ করতে করতে উপরে ওঠেন। সেইসময় যেন অন্য ঘোরে থাকেন তিনি। সাধারণ কেউ যে ভয় পাবে, বা যে সমস্যার কথা ভাববে, সেসব বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না তাঁকে।
ধ্বজা বদলের আগে দুই বাহু প্রসারিত করে উপরের দিকে তাকান। জানতে চাইলাম, কী প্রার্থনা করেন? মৃদু হেসে জানালেন, বিশ্ব সংসার আগলে রাখেন যিনি তাঁর কাছে নতুন করে কী ই বা চাইতে পারি! তবে কী বিশেষ কোনও মন্ত্র জপ করেন? সে প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য সম্মতিই জানিয়েছেন নৃসিংহ। গুরু স্মরণে তাঁর দেওয়া মন্ত্র জপ করেন মন্দিরের চূড়ায়। তারপর ধ্বজা বদল। কাঁধে থাকা নতুন পতাকা যত্ন নিয়ে পরিয়ে দেওয়া ধ্বজা-দণ্ডে। পুরনোটি খুলে নেওয়া। এইসময় বার কয়েক ধ্বজা প্রণাম করতেও দেখা যায় নৃসিংহকে। মন্দিরপ্রাঙ্গনে তখন একটাই রব, ‘জয় জগন্নাথ’। সেই ধ্বনি অত উপরে না পৌঁছলেও, নৃসিংহ বেশ টের পান ভক্তদের আর্তি।
নামার সময় প্রদীপ নিয়ে আরতি করেন, মন্দিরের চূড়াতেই। সেই দীপ রেখে নেমে আসেন নিচে। অনেকেই এরপর ঘিরে ধরেন তাঁকে। একটি বার সেই পাদস্পর্শ করেন, যা এতক্ষণ শ্রীমন্দিরের চূড়া স্পর্শ করেছে। সেইসঙ্গে পতাকা কেনার ধুম। বোঝাই গেল, এইসব তেমন পছন্দ নয় নৃসিংহের। খানিকক্ষণ জোড় হাতে সকলের প্রণাম গ্রহণ করে সরে গেলেন। পিছু নিয়ে পৌঁছলাম মন্দিরের অন্য প্রান্তে। এই জায়গাটা পুরীর মন্দিরের অংশ হলেও, খুব একটা ভিড় নেই। এর ঠিক পাশেই জগন্নাথের সমাধি। নির্দিষ্ট সময়ের পর জগন্নাথ বিগ্রহের নবকলেবর হয়। নতুন বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা, পুরনো বিগ্রহের সমাধি। সেদিকে তাকিয়েই নিজের কথা বলতে শুরু করলেন নৃসিংহ।
জানলাম, এই ধ্বজা পরিবর্তনের গুরুদায়িত্ব সামলান তাঁর পরিবারের সদস্যরাই। স্থানীয় ভাষায় এঁরা ‘চুনরা সেবক’। যদিও স্রেফ এই একটা কাজ নয়। মন্দিরের আরও অনেক দায়িত্ব তাঁদের সামলাতে হয়। তার মধ্যে ধ্বজা পরিবর্তন প্রধান কাজ বলা যায়। এর আগে এই কাজ করতেন নৃসিংহের বাবা শ্রীধর মহাপাত্র। তাঁর কাছেই হাতেখড়ি। মাত্র ৮ বছর বয়সে প্রথমবার মন্দিরের চূড়ায় উঠেছিলেন। এত ছোট বয়সে এমন দুঃসাহসী কাজ করা মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু জগন্নাথের আশীর্বাদে এই কাজ করতে পেরেছিলেন। যদিও স্রেফ জগন্নাথ নন, চোখ বন্ধ করে দেবী বিমলার কথাও বললেন নৃসিংহ। তিনিই সেবায়েত পরিবারের কুলদেবী। তাই বিমলা মাতা রক্ষা করেন, আগলে রাখেন, এই কথা বারবার শোনা গেল নৃসিংহের মুখে। কখনও এই কাজে বাধার মুখে পড়েননি, সেও দৈবের গুণে, এমনটাই মনে করেন তিনি। তাই আগামীদিনেও নিষ্ঠাভরে এই কাজ করে যেতে চান।
তবে কৌতুহলের বশে জানতে চেয়েছিলাম, মন্দিরের চূড়ায় কোনও অলৌকিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন কি না! সেইভাবে উত্তর দেননি নৃসিংহ। আলাদা কোনও রোমাঞ্চ হয় না এই কাজে। কারণ ধ্বজা পরিবর্তনকে কাজ নয়, সেবা হিসেবে দেখেন তিনি। প্রভুর চরণে নিজেকে সমর্পণ করে তাঁর নির্দেশে যাবতীয় যা কিছু করে যাওয়া, এমনটাই তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য, বললেন নৃসিংহ। কথার মাঝে অনেকেই এলেন দেখা করতে। সকলের উদ্দেশে একটাই পরামর্শ দিলেন নৃসিংহ, ভালোবাসতে শিখুন, ভালো থাকতে শিখুন। জগন্নাথ জগতের নাথ। আমরা তো নিমিত্ত মাত্র, অভিনেতা। তাঁর পরিচালনায় গোটা সংসার চলছে, সেখানে আলাদা করে ক্ষোভ দ্বেষ হিংসা মনে মনে পোষণ করা একেবারেই উচিত নয়। এইসবকিছুই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে শোনা গেল তাঁকে। নতুন বছরে এতটুকু খারাপ ভাবনা মাথায় আনতে নারাজ নৃসিংহ। প্রভুর কৃপায় সব ভালো হবে, এই বার্তাই সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। ঠিক যেভাবে তাঁর রুটিনে কোনও হেরফের হতে দেন না জগন্নাথ, সেইভাবে সকল ভক্তের জীবনকে সমান গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও তাঁর, স্রেফ মনে ভরসাটুকু রাখতে হবে।