হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী। চারদিকে কান পাতলেই হানাহানি, ধর্মীয় বিদ্বেষের খবর। এরই মধ্যে আরও একটা বুদ্ধপূর্ণিমা। বুদ্ধদেবের জন্মদিন। তথাগতের বোধিপ্রাপ্তির দিন আবার তাঁর মহাপরিনির্বাণ বা মোক্ষলাভেরও দিন বটে। এই ত্রহ্যস্পর্শ লেগে রয়েছে বৈশাখী পূর্ণিমার দিনটিকে ঘিরে। সেই তথাগত, যিনি বলছিলেন, ‘সবেব সত্তা ভবন্তু সুখীতত্ত্ব’। অর্থাৎ জগতের সব প্রাণ, সমস্ত সত্তা সুখী হোক। তা তাঁর সেই কথা আদৌ কি মনে রেখেছে এ বিশ্ব?এই দিনটির মাহাত্ম্যই বা কী? আসুন, শুনে নিই।
‘আত্মানং বিদ্ধি’। অর্থাৎ নিজেকে জানো। আর সেই ব্রহ্ম তথা নিজেকে জানতেই একদিন ঘরসংসার, নগর, প্রজাগণ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন রাস্তায়। কপিলাবস্তুর রাজপরিবারে তাঁর জন্ম। রাজা শুদ্ধোদন ও রানি মায়াদেবীর কোল আলো করে বাগানের শালবৃক্ষের ছায়ায় জন্ম হয়েছিল তাঁর। ছোট থেকেই সে বালক যেন অন্য ধাতুতে গড়া। অল্প বয়সে প্রায় সমস্ত ক্ষত্রিয়দের মতোই তাঁরও অস্ত্রবিদ্যায় হাতে খড়ি হয়। খেলাধুলা ও কৃষিকাজেও অল্প সময়েই অর্জন করেন দক্ষতা। তবু সংসারে থেকেও যেন ছোট্ট ছেলেটার ছিল অদ্ভুত নির্লিপ্তিতে। মাঝেমধ্যেই আনমনে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেত সে। সে যেন ছিল সার্বিক তথাগত হয়ে ওঠারই প্রস্তুতি। তারপর এক রাত্তিরে স্ত্রী ও সদ্যজাত সন্তানকে ঘুমন্ত রেখে ঘর ছাড়লেন সিদ্ধার্থ। ৬ বছর ধরে চলল কঠোর তপস্যা। তারপর একদিন নিরঞ্জনা নদীর তীরে বটবৃক্ষের তলায় বোধিপ্রাপ্ত হলেন তিনি। সেদিনও এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাত। আকাশে তখন একথালা চাঁদ। নতুন জন্ম হল ৩৫ বছরের সিদ্ধার্থের। না, আর সিদ্ধার্থ নন। আজ থেকে তিনি তথাগত।
আরও শুনুন: দোলপূর্ণিমা তিথিতেই আবির্ভাব মহাপ্রভুর, কেন তখন হয়েছিল চন্দ্রগ্রহণ?
বৈশাখ মাসের এই পূর্ণিমা তিথি তাই বৌদ্ধাধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিনে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা স্নান করে পট্টবস্ত্র পরেন। তারপর চলে গৌতম বুদ্ধের আরাধনা ও নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। মনে করা হয়, এই দিনে বুদ্ধের উপাসনা করলে পার্থিব দুঃখ কষ্ট থেকে পরিত্রাণ মেলে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে এই দিনটা তাই আলোর দিন। এ দিনটাকে আলোর উৎসব হিসেবেই পালন করেন তাঁরা। গরিব-দুঃখীদের পেট ভরে খাওয়ান অনেকে। করেন দানধ্যানও।
শুধু বৌদ্ধদের কাছেই নয়, হিন্দুদের কাছেও এ দিনটির মাহাত্ম্য কিছু কম নয়। হিন্দু ধর্ম অনুসারে, বিষ্ণুর নবম অবতার গৌতম বুদ্ধ। এর পাশাপাশি চন্দ্রদেবের পুজোরও রেওয়াজ রয়েছে এই দিনে। প্রচলিত বিশ্বাস, বুদ্ধদেবের পাশাপাশি এই দিন চন্দ্র ও বিষ্ণুর উপাসনা করলে ইচ্ছেপূরণ হবেই হবে। বিহার-সহ বেশ কিছু জায়গায় এদিন মেলা বসে। বৌদ্ধবিহারে বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে চলে তিনদিনব্যপী অনুষ্ঠান।
আরও শুনুন: এই বনে রাসলীলায় মাতেন রাধাকৃষ্ণ, অলৌকিক রহস্যের ঠিকানা বৃন্দাবনের নিধুবন
‘বৌদ্ধং শরণং গচ্ছামি’- বৌদ্ধধর্মের মূল কথাই তাই। এ ধর্মে কোনও জাতিভেদ নেই। হিংসার কথা নেই। কেবল বুদ্ধের শরণ নেওয়াটুকুই সার। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, বুদ্ধ কেবল তথাগত নন, তিনি যেন চেতনারই দ্যোতক। আর সেই চর্চার শরণে যাওয়ার কথাই বলে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রচলন করতে চেয়েছিলেন তিনি। শুরু করেছিলেন সংঘের। সর্বজীবে মৈত্রীকেই মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। সে কথা নিজের একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মানবতার সেই অবিচল ধর্মের কথাই বলতে চেয়েছিলেন গৌতমবুদ্ধ। তবে আজ বোধহয় সেই পন্থার কথা ভুলতে বসেছে বিশ্ব। অন্তত চারদিকে যেভাবে হিংসার উন্মত্ততা সেদিকে তাকালে তেমনটাই মনে হয়। এই বুদ্ধপূর্ণিমার সেই শুভবুদ্ধিটুকুই ফিরুক দুনিয়ায়। এর বেশি আর কী-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে।