এ বলে, আমার ধর্ম ভাল। তো ও বলে, আমার ধর্মটাই সেরা। একজন বলে, আমার কথাই ঠিক। অন্যজনের আবার মত, তার কথাটাই নির্ভুল। এই নিয়েই চলে তর্ক। মাথাচাড়া দেয় বিভাজন। কিন্তু আসল কথাটি হল এই পর্দা সরে গেলে দেখা যায় সকলই এক। শোনাচ্ছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।
ধর্মে-ধর্মে, সম্প্রদায়ের-সম্প্রদায়ে নানা বিভাজন। যুগে যুগেই এই বিভাজনের পর্দা এসে মানুষকে আলাদা করেছে। ধর্মের পথে চলতে গিয়েও মানুষ আশ্রয় করেছে ভেদবুদ্ধিকে। তার থেকে জন্ম নিয়েছে অহং। তখন মনে হয়েছে ঈশ্বরচিন্তায় আমার ধর্মই সেরা। আমার সম্প্রদায়ই শ্রেষ্ঠ। এই নিয়ে কত না দ্বন্দ্ব বিবাদ থেকে থেকেই মাথাচাড়া দেয়। আর যুগে যুগে মহাপুরুষরা এসে আমাদের শুনিয়ে যান, এর বিপরীত কথা। তাঁরা বলেন, এই বিভাজনের কোনও অর্থ নেই। কেননা যিনি এক, যিনি পরম তাঁকেই আমরা নানা নামে, নানা ভাবে ব্যাখ্যা করে চলেছি – এই যা।
বাউলের কথায় তাই পাওয়া যায় এক শাশ্বত সত্যের সন্ধান। বাউল বলে,
একই আকাশ ঘটে ঘটে
একই গঙ্গা ঘাটে ঘাটে।
যদি প্রশ্ন করা হয়, গঙ্গা তুমি কোন প্রদেশের? কেউ বলবেন, অমুক রাজ্যের, তো কেউ বলবেন তমুক প্রদেশের। কিন্তু সে তো পবিত্র গঙ্গাকে সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধিতে আটকে ফেলা হবে মাত্র। ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভক্তসাধক যাঁরা, সন্ত যাঁরা – তাঁরাও তাই এই একের কথাই বলে থাকেন। বলেন, যিনি এক এবং অদ্বিতীয় তাঁকে ভাগ করবে কেমন করে? কীসের আচার বিচার আর কীসের সম্প্রদায়গত বিভাজন! এক-কে কখনও ভাগ করা যায় না।
ভক্ত দাদূ-র কথা আমরা জানি। তাঁকে একবার বলা হল, যদি মানুষের সেবা করতে চাও, তবে তোমাকে কোনও এক সম্প্রদায়ভুক্ত হতে হবে। দাদূ তখন ভেবে ভেবে ঈশ্বরের কাছেই ক-টা প্রশ্ন করলেন? জিজ্ঞেস করলেন, হে দয়াময়, এই যে আকাশ, জল, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য নিরন্তর মানুষের সেবায় ব্রতী হয়ে রয়েছে, এরা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত? যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের নামে এত সম্প্রদায়, সেই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর নিজে কোন সম্প্রদায়ের ছিলেন? যাঁদের নাম নিয়ে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে এত ভাগাভাগি, সেই মূলের মানুষরা কোন্ সম্প্রদায়ের ছিলেন? এইসব প্রশ্নই তিনি করলেন ঈশ্বরকে। দাদূর এ-প্রশ্ন তো প্রশ্নমাত্র নয়। এ যেন প্রশ্নের ভিতরই উত্তরের স্বয়ংপ্রকাশ। যা আমাদের বলছে, এই যে এত বিভাজন, ভেদাভেদ, ধর্মে ধর্মে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে এত ঠোকাঠুকি সে সবই মানুষের তৈরি করা। আরোপিত সত্য। প্রকৃত সত্যি নয়।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও গল্পচ্ছলে এই সত্যিই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি শোনাচ্ছেন জনাকয় মানুষের কথা। তারা গিয়েছিল জঙ্গলে। একজন ফিরে এসে বলল, সে এমন একটা প্রাণী দেখেছে, যার গায়ের রং লাল। শুনে তার বন্ধু বলল, প্রাণীটিকে সে-ও দেখেছে বটে, তবে গায়ের রং লাল তো নয় হলুদ। অন্য একজন বলল, ছাই দেখেছ! লাল বা হলুদ হতে যাবে কো দুঃখে, প্রাণীটির গায়ের রং আসলে সবুজ। এই নিয়েই বেধে গেল ঝগড়া। কথা কাটাকাট। চারিদিকে লোক জড়ো হয়ে গেছে। হাতাহাতি এই লাগে আর কি!
সেই জঙ্গলে থাকতেন এক সাধু। তিনি এই ঝগড়া শুনে বললেন, অকারণেই এত কথার অবতারণা। যে প্রাণীর কথা হচ্ছে, তাকে তিনি নিত্যদিন দেখেন। সে আসলে একটা বহুরূপী। কখনও তার গায়ের রং সবুজ, তো কখনও লাল, আবার কখনও হলুদ। কখন যে কী রং তার তো ঠিক নেই, তাই নিশ্চিত করে কোনও একটা রং চিহ্নিত করা যাবে না। অর্থাৎ, আলাদা আলাদা ব্যক্তি যা বলছিল এতক্ষণ, তারা তা ঠিকই বলছিল, কিন্তু তাদের দেখা খণ্ডিত। আর সাধু দেখেছেন সমগ্র। তাই তিনিই জানেন প্রকৃত সত্যি আসলে কোনটা। সাধুর কথায় সব বিবাদ তখন মিটে গেল।
এই গল্পই আমাদের বলে দেয়, এই যে এত বিভাজন ঝগড়া সে কেবলই আমাদের খণ্ডিত দর্শনের ফল। কিন্তু যিনি বিস্তারে দেখতে জানেন, দেখতে পারেন সমগ্রকে – তাঁর কাছে আর বিভাজন গ্রাহ্য হয় না। তিনি সর্বত্রই দেখেন পরমের প্রকাশ। একের অধিষ্ঠান। ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথের কথাতেই যেন ধরা আছে এই অনুভবের সবটুকু –
তোমারে শতধা করি ক্ষুদ্র করি দিয়া
মাটিতে লুটায় যারা তৃপ্ত সুপ্ত হিয়া
সমস্ত ধরণী আজি অবহেলা ভরে
পা রেখেছে তাহাদের মাথার উপরে।