এত বড় অস্বস্তিতে যে পড়তে হবে তা দু-বছর আগেও ভাবেনি বাঙালি। পুজোর আনন্দ ঘরের সামনে, তাকে ‘না’ বলে দেবে, নাকি বেরিয়ে পড়বে জয় মা দুর্গা বলে। বাঙালির কেউ কেউ দ্বিধায় দুলছেন এখনও। আর কেউ কেউ আবার বেরিয়েই পড়েছেন। আর তাই আনন্দ উৎসবের ভিতরও থেকে যাচ্ছে মৃদু আশঙ্কা।
উভয়সংকটের দ্বিতীয় বছর। জন্ম-মৃত্যু নিয়ে টানাটানি পড়ে গেছে বাঙালির। কথা হল, পুজোর আনন্দে মাতব, না করোনায় মৃত্যু থেকে বাঁচব। বীরেন্দ্র-সকাল মহালয়া থেকে শুরু হয়েছে নিশিডাক! যত শিউলি ঝরছে, যত নদীর পাড়ের দুলে উঠছে কাশ, যত নিম্নচাপের ভ্রুকুটি ডিঙিয়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের উঁকি, যত কাগজে-টিভিতে জুতো-জামার বিজ্ঞাপন আর কানে আসছে ঢাকের বাদ্যি, তত বাড়ছিল চাপা অস্বস্তি! প্রশ্ন জাগছিল, পথে বেরিয়ে মাস্কহীন ভিড়ে পৈতৃক প্রাণটা খোয়াবো, নাকি ঘরে খিল এঁটে বসে থাকব?
কী জটিল পরিস্থিতি! পাহাড় চড়ার আনন্দের মতো ভয়! শীর্ষে ছুঁলে মেলে নশ্বরতার সেরা স্বাদ। আবার খাড়াই জীবনের মাঝপথে দফারফা হওয়ারও ষোলোআনা চান্স! এদিকে নিশি ডাকছে বুর্জ খলিফা! অপূর্ব করেছে উত্তর থেকে দক্ষিণের বহু থিমপুজো! করোনার হাজার ঝামেলার পরও। কত কষ্ট ডিঙিয়ে লা-জবাব মাতৃপ্রতিমা গড়েছেন মৃৎশিল্পীরা! এমন আলোর খেলায় জীবনের লীলারই তো জয়! কিন্তু উরে বাবা কী ভিড়! তার উপর মুখে আবার মাস্ক নেই। বাকি অর্ধেকেরও অর্ধেকের থুতনিতে ঝুলছে কিছুটা। মাস্ক বাবাজিও জানে না, লোকটা মাস্ক পরেছে, নাকি সেই কোনওক্রমে লোকটাকে পরে আছে! তারপর ধরুন, সিজিন চেঞ্জই হবে বোধ হয়। অনেকেরই গলায় লেগে আছে খুচরো কাশি। এমনটাই ভেবে নেওয়া যেত। মহালয়া, নবপত্রিকা, সন্ধীপুজো, নীলকণ্ঠ পাখি ইত্যাদির মাহাত্ম্য যত আলোচনায় ফিরছে, সেই সঙ্গে ফিরছে দুর্গাপুজোর মাত্রাছাড়া ভিড়ে করোনা বাড়তে বলে সতর্কতাও। যদি বেগতিক কিছু হয়, তার জন্য প্রস্তুতি অবশ্য সেরে রেখেছে সরকার। কিন্তু বলুন তো বাঙালি এখন যায় কোথায়!
আরও শুনুন: লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ কি দেবী দুর্গার সন্তান?
এই আমরা, যাদের ডাকনাম নিম্ন মধ্যবিত্ত। বছরে একবারই জুতো-জামার সঙ্গে দেখা। সারা বছর তো আর বোনাস মেলে না। ব্যবসাতেও দু-পয়সা বাড়তি কামান এই সময়েই। আমরা তো আর টিভি-সিনেমা-ওয়েব সিরিজের মানুষ না, যে বছরের যে কোনও সময় ছুটি কাটাতে চল্লুম থাইল্যান্ড, কিংবা রইল ঝোলা চলল ভোলা হাওয়ায়ই দ্বীপের হাওয়া খেতে, বড় মানুষের মতো ছোট পোশাকে সমুদ্রপাড়ে রৌদ্রস্নানের গল্প নেই আমাদের জীবনে।
মোদ্দা কথা, আমরা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব। আমরা কেরানি, আমরা বস্ত্রালয়, পাদুকালয়ের দোকানদার, বাজারে সবজি বেচি, আমরা ঘটিগরমওলা, ট্রেনে হকারি করি। এক্কেবারে আম আদমির দল। আমাদের জানলা খুললে সারা বছর রোদ আসে না। আসে এই আশ্বিনে। দু-পাশে ছেলেপুলে, মাথার উপর বর নিয়ে যখন মা আসে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে, তখনই আসে। আর ঝলমল করে ওঠে আমাদের জীবনও! ঠাকুর দেখতে না বের হলে, লাইন দিতে দিতে হাঁফিয়ে ফুচকা, এগরোল, আইসক্রিম, বরফ পান না খেলে – যেন শারদ রোদ ওঠে না তেমন করে!
আরও শুনুন: মৃত্যু হয় হুদুড় দুর্গার, দুর্গাপুজোর সময় আজও শোকপালন করেন ‘মহিষাসুরের বংশধররা’
তাহলে কি মাস্ক পরে জয় মা দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়ব? নাকি করোনাকে ভয় করব, ঘরে খিল এঁটে বসে থাকব, জীবন থেকে জীবনকে বাদ দেব আরও একবার! উফ কি উভয়সংকট! তবু এ কথা সত্যি, যে, অনেকটাই অবসাদ কাটিয়ে মানুষ বেরিয়েছে। সতর্কতা মেনেই চলছে দর্শন। কেউ কেউ অবশ্যি মৃদু আশঙ্কায় এখনও দ্বিধান্বিত। এই দোলাচলের ভিতরই এগোচ্ছে একুশের শারদ উৎসব। বচ্ছরকার এই আনন্দটুকু যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই উপভোগ করছেন।