গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুদেব মহেশ্বর, গুরু সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ
সংস্কৃতে ‘গূ’ শব্দের অর্থ, অন্ধকার, ‘রু’ শব্দের অর্থ আলো। গুরু শব্দের সমগ্র অর্থ, যিনি অন্ধকার থেকে আমাদের আলোর দিকে নিয়ে যান। ধর্মের গণ্ডিতে গুরুকে অনুধাবন করা অসম্ভব। তিনি জীবনের পথ নির্দেশক। সঠিক গুরুর দেখা না পেলে হয়তো স্বামী বিবেকানন্দের পরিচিতি অন্য রকম হত। গুরু না থাকলে অর্জুনও হয়তো বিশ্বসেরা ধনুর্বিদ হতে পারতেন না। সেই গুরু স্মরণ করার দিন গুরুপূর্ণিমা। কী বিশেষ মাহাত্ম্য এই দিনের? আসুন শুনে নিই।
ভারতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা যথেষ্ট প্রাচীন। এই দেশ প্রাচীনতার দেশ, মহানতার দেশ। শাস্ত্রমতে একসময় মুনি ঋষিরা কঠোর তপস্যার মাধ্যমে দেবতার সান্নিধ্য লাভ করতেন। পুরাণের গল্পে এর অজস্র উদাহরণও রয়েছে। এমনই এক গল্পে গুরুপূর্ণিমার মাহাত্ম্য বর্ণনা মেলে। সেই কাহিনি খানিকটা এরকম।
আরও শুনুন: রাধা নয়, কৃষ্ণপত্নী দেবী রুক্মিণীর মন্দিরে পুজো দিলেই চিরকাল অটুট থাকে প্রেম
অন্তত পনেরো হাজার বছর আগের কথা। কৈলাসে কঠোর যোগে মগ্ন মহাদেব। সাতজন শিষ্য তাঁর থেকে শিক্ষালাভের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। মহাদেব তাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত অবধি করেননি। এই সাতজন ছিলেন সপ্তঋষি। অত্রি, অঙ্গিরা, মরীচি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু এবং বশিষ্ঠ। মনে করা হয়, আকাশে দেখতে পাওয়া সপ্তর্ষিমণ্ডল আসলে এঁদেরই ইঙ্গিত করে। কিন্তু মহাদেবের কাছে তাঁরা ভক্ত স্বরূপ। তাই দীর্ঘক্ষন তাঁদের অপেক্ষাতেই কাটাতে হয়। দৈব ঘটনার সঙ্গে সাধারণ কিছুর তুলনা করলে, অবাস্তব ঠেকতে পারে। এক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। অপেক্ষা শুনলে অনেকেরই মনে হতে পারে, বেশ কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু কার জন্য অপেক্ষা করছেন সে কথাও খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সপ্তঋষিকে প্রায় আশি বছর অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু তখনও একইভাবে যোগধ্যানে মগ্ন দেবাদিদেব। অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও সাত বছর। এমনই এক দিনে, মর্তে তখন ভরা পূর্ণিমা। চোখ খুললেন মহেশ্বর। আদিযোগী শিব প্রকট হলেন আদিগুরু রূপে। সাতাশি বছরের অপেক্ষার পর সেদিন তিনি চেয়ে দেখলেন, তাঁর শিষ্যদের দিকে। দেখলেন তাঁরা হয়ে উঠেছেন দীপ্তিমান, জ্ঞান ধারণের আধার। অপেক্ষায় তাঁরা ম্লান হয়ে যাননি। তাঁদের জ্ঞানতৃষ্ণা তখনও বর্ষার নবতরুদলের মতো সজীব। তিনি নিজেকে আটকে রাখলেন না। পূর্ণিমার বিশেষ এই দিনে উদ্দেশ্যে ব্রতী হলেন শিষ্যদের শিক্ষা প্রদানে। তিনিই প্রথম জগৎ গুরু। সেইদিন থেকেই এই বিশেষ দিন পূর্ণিমা, গুরুর উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত।
আরও শুনুন: ছয় মাথা, আঠারো চোখ, দেবী কামাখ্যার এমন রূপের মাহাত্ম্য কী?
বিবেকানন্দ বলেছিলেন জীব সেবাই শিব সেবা। সেই অর্থে আর্ত পীড়িত মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলে শিবের আশীর্বাদ ধন্য হবেন যে কেউ। অন্যদিকে পূর্ণিমা মাত্রেই নারায়ণের প্রিয় তিথি। তাই এইদিন নারায়ণ পুজো করলেও শুভাশুভ ফল মেলে। সেইসঙ্গে প্রত্যকের জীবনেই প্রথম গুরু তাঁর বাবা-মা। তাই গুরুপূর্ণিমায় তাঁদের অশ্রদ্ধা যেন কোনওভাবে না হয়, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। অন্ধকার আমাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অজ্ঞনতা, ভয়, সংশয়, জিজ্ঞাসা, সন্দেহ। এইসব যিনি অনায়াসে দূর করেন, তিনিই গুরু। তিনি জ্যোতির্ময়।
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।।
অর্থাৎ, যিনি অজ্ঞান নামক অন্ধকার থেকে জ্ঞান নামক শলাকার মাধ্যমে আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেন, সেই গুরুকে প্রণাম জানাই।