ঈশ্বরের স্বরূপ কেমন? তা নিয়ে যুগে যুগে নানা প্রশ্নের অবতারণা। জ্ঞানীজন তাঁকে নানা রূপে কল্পনা করেন। তবে সাধারণ মানুষ তা বুঝবেন কী করে? আর তাই সকলের জন্য নিজের পরম রূপের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বর স্বয়ং। শ্রীগীতায় অর্জুনকে দিয়েছিলেন সেই ব্যাখ্যা। আসুন শুনে নিই।
যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মীয়দের রণসজ্জায় সজ্জিত দেখে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন অর্জুন। সেই বিষাদ কাটানোর দায়িত্ব নেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। সেদিন তিনি অর্জুনকে যা বলেছিলেন, তাই-ই গীতার জ্ঞানরাশি হিসাবে মানবসমাজে প্রচারিত।
আরও শুনুন: গীতা ছিল প্রিয় গ্রন্থ, মহাত্মার কাছে যে শ্লোকগুলি হয়ে উঠেছিল মহামন্ত্র
শ্রীগীতায় ভগবান নিজের মুখে অর্জুনকে বলেছিলেন, অধর্ম বিনাশের জন্য, ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যুগে যুগে আবির্ভূত হন। এই কথার মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, ভগবান শুধুমাত্র অর্জুনের সময়কালে এসেছেন তা নয়, আগেও এসেছেন; পরেও আসবেন; আর তাঁর অমূল্য বাণী তিনি জগৎবাসীকে শুনিয়েছেন, মানুষকে উদ্ধার করতে। এই জগতের যা কিছু ক্লেশ, মায়া ও মোহ, তা থেকে উত্তরণ ঘটাতেই ভগবান এই অমূল্য জ্ঞানরাশি উপহার দেন জগৎবাসীকে। গীতার মোট ১৮ অধায়। যার প্রথমে রয়েছে গীতার প্রস্তাবনা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে কেন গীতপাঠের প্রয়োজন তার ব্যাখ্যা। দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তিযোগ এবং পঞ্চদশ অধ্যায়ে রয়েছে পুরুষোত্তম যোগ। এই পুরুষোত্তম যোগ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পছন্দের বলেই জানা যায়। এখানে ভগবান বলছেন, জীব মাত্রেই তাঁর সনাতন অংশ। নিজ কর্মফল অনুযায়ী দুঃখ ভোগ করে সকলে। দেহত্যাগের পর যা আবার সূক্ষ্মশরীরে পরিণত হয়। পুণরায় জন্মগ্রহণ মাত্র স্থূল শরীর ধারণ, এবং ভোগবিলাস। জীবের এই জন্মকর্ম-তত্ত্ব অজ্ঞ ব্যক্তি বুঝতে পারে না। কেবল জ্ঞানীগণ জ্ঞাননেত্রে তা অনুভব করেন। এখানেই ভগবান বলছেন তিনি সর্বকারণের কারণ। পঞ্চদশ অধ্যায়ের শ্লোক ১২-তে দেখা যাচ্ছে,
যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ভাসয়তেবখিলম্।
যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তোজো বিদ্ধি মামকম্।।
অর্থাৎ, যে তেজ সূর্যে থাকে এবং সমগ্র জগৎ উদ্ভাসিত করে, এবং যে তেজ চন্দ্রমা ও অগ্নিতে রয়েছে, তার সবই ভগবানের তেজ। চন্দ্রসূর্যাদি সমস্তই তাঁর সত্তায় সত্তাবান, তাঁর শক্তিতে শক্তিমান। তিনিই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে পঞ্চভূতকে ধারণ করেছেন। তাঁর শক্তিতেই সবকিছু পরিপুষ্ট। ভগবান বলছেন, তিনি জঠরাগ্নিরূপে দেহ রক্ষা করেন, আবার তিনিই অন্তর্যামি হয়ে সর্বজীবের অন্তরে অধিষ্ঠিত। তিনিই বেদসমূহে একমাত্র জ্ঞাতব্য এবং তিনিই আচার্যরূপে বেদান্তের অর্থ প্রকাশ করছেন। এরপর আসে পুরুষোত্তম তত্ত্বের কথা। সেখানে ভগবান বলছেন,
আরও শুনুন: নিয়ম মেনে পুজো করলেই কি ঈশ্বরের প্রিয় পাত্র হওয়া যায়? ব্যাখ্যা রয়েছে গীতাতেই
যস্মাৎ ক্ষরমতীতো বহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ।
অতোবস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ।।
অর্থাৎ, যেহেতু তিনি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর অপেক্ষা উত্তম, সেই হেতু তিনি লোক-ব্যবহারে এবং বেদে, পুরুষোত্তম হিসেবে পরিচিত। লোকে ক্ষর বা সর্বভূত, প্রকৃতি-জড়িত জীব ও অক্ষর কিংবা নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব এই দুই পুরুষ প্রথিত রয়েছে। ভগবান সেই ক্ষরের অতীত, এবং কূটস্থ অপেক্ষা উত্তম। তাই তিনি পুরুষোত্তম। বেদেও তিনি আবার লোকব্যবহারেও তাঁর অপেক্ষা উত্তম কিছু নেই। তাঁকে এইরূপে কল্পনা করলে আর কিছু জানার অবশিষ্ট থাকে না। তখন জীবের এই অনুভূতি হতে বাধ্য, তিনিই নির্গুণ, তিনিই সগুণ, তিনিই বিশ্বরূপ, তিনিই অবতার শ্রেষ্ট এবং তিনিই আত্না। এই পুরুষোত্তম তত্ত্ব সর্বতোভাবে জানলেই তাঁকে ভজনা করা হয়,সর্বসাধারণের উদ্দেশে এই জ্ঞানই বিতরণ করেছিলেন স্বয়ং ভগবান।