নদীমাতৃক ভারতবর্ষে মাতৃস্বরূপা গঙ্গানদী। দেশের একাধিক জনপথ তাঁর তীরেই গড়ে উঠেছে। গঙ্গা স্রেফ নদী নয়, হিন্দুধর্মের পরম পূজনীয় এক দেবীও। যদিও এই দেবীত্বে উত্তরণের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক পৌরাণিক ব্যাখ্যা। এমনকি গঙ্গার উল্লেখ মেলে মহাভারতেও। তবে সব থেকে প্রচলিত, ভগীরথের আহবানে গঙ্গার মর্ত্যে আগমনের কাহিনীটি। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
পতিতোদ্ধারিণী, পুণ্যদায়িনী দেবী গঙ্গা। সনাতন ধর্মে তাঁর বিশেষ স্থান। শুধুমাত্র দেবীজ্ঞানে পুজো নয়, গঙ্গাজল যেকোনও শুভকাজে আবশ্যক। মনে করা হয়, গঙ্গাজলের ছোঁয়ায় যে কোনও অপবিত্র জিনিস পবিত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু এই গঙ্গা নদীর জন্ম কীভাবে? তার ভৌগলিক ব্যখ্যা অবশ্যই রয়েছে। তবে পুরাণেও বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে গঙ্গার জন্ম বৃত্তান্ত। সেইসঙ্গে দেবীরূপে গঙ্গার মর্ত্যে আগমন হল ঠিক কীভাবে, সে ব্যাখ্যাও পুরাণেই মেলে।
আরও শুনুন: মনসাপুজোর অন্যতম তিথি, দশহরায় কোন নিয়ম পালনে বিশেষ ফল মেলে?
গঙ্গা জন্মের প্রসঙ্গে প্রথমেই উঠে আসে ব্রহ্মার কথা। কথিত আছে তাঁর কমন্ডলু থেকেই জন্ম হয়েছিল গঙ্গার। যেহেতু স্বয়ং ব্রহ্মার কমণ্ডুল থেকে সৃষ্ট, তাই গঙ্গাকে দেবী হিসেবে অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার এমনটাও মনে করা হয়, গঙ্গা হিমালয় রাজের কণ্যা। দেবী পার্বতীর বোন। তবে জন্ম প্রসঙ্গের থেকেও গঙ্গা সম্পর্কে যে পৌরাণিক আখ্যান অধিক প্রচলিত তা হল গঙ্গার মর্ত্যে আগমনের কাহিনীটি। সেই কাহিনী শুরু হয় রাজা সগরের সাম্রাজ্যে। দয়াবান বীর রাজা সগর ঈশ্বরের আশীর্বাদে ষাট হাজার পুত্রের জনক হয়েছিলেন। আনন্দে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। কিন্তু সেই আয়োজন দেখে হিংসায় ফেটে পড়েন দেবরাজ ইন্দ্র। ছল করে যজ্ঞের মূল ঘোড়াটি অপহরণ করে নেন তিনি। রাজা তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে সেই ঘোড়ার খোঁজ করতে পাঠান। তাঁরা পাতালপুরীতে ধ্যানমগ্ন ঋষির কাছে ওই ঘোড়াটিকে দেখতে পান। তক্ষনি সেই মহর্ষিকে চোর সন্দেহ করে তার বহু বছরের ধ্যান ভঙ্গ করেন ওই ষাট হাজার সন্তান। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, ওই ঋষি আসলে মহর্ষি কপিল। ধ্যানভঙ্গ হতেই তিনি ভয়ানক চটে যান। তখনি দৃষ্টিপাত করে একসঙ্গে ষাট হাজার সন্তানকে ভস্ম করে দেন। সগর রাজার ষাট হাজার সন্তানের আত্মা পারলৌকিক ক্রিয়ার অভাবে প্রেতরূপে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ঘটনার বহুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর, সগর রাজের এক বংশধর, তথা রাজা দিলীপের পুত্র ভগীরথ সিদ্ধান্ত নেন ওই ষাট হাজার পূর্বপুরুষের আত্মাকে মুক্তি দেবেন। এদিকে এই কাজ কেবলমাত্র করতে পারেন দেবী গঙ্গা। কিন্তু তাঁকে সেই অনুরোধ করবে কে? একমাত্র ব্রহ্মাই পারেন গঙ্গাকে নির্দেশ দিতে। তিনি তুষ্ট হলেই গঙ্গা এই কাজে রাজি হবেন। তাই ব্রহ্মার তপস্যা শুরু করেন ভগীরথ। তপস্যায় সন্তুষ্ট ব্রহ্মা গঙ্গাকে মর্ত্যে প্রবাহিত হয়ে সগরপুত্রদের আত্মার সদগতিতে সহায়তা করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু দেবী গঙ্গার এই নির্দেশ খুবই অসম্মানজনক মনে হয়। তিনি ঠিক করেন এতটাই তীব্র গতিতে মর্ত্যে নামবেন যে মুহূর্তের মধ্যে চারিদিক প্লাবিত হয়ে যাবে। তখন ভগীরথ গঙ্গার সেই তীব্র গতিরোধ করার জন্য শিবের আরাধনা শুরু করেন। সেই আরাধনায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে আশ্বস্তও করেন। এবং তীব্র গতির গঙ্গাকে শিব শান্তভাবে নিজ জটাজালে আবদ্ধ করেন। তারপর ছোটো ছোটো ধারায় তাকে মুক্তি দেন। এদিকে শিবের সান্নিধ্যে গঙ্গা শান্ত হন। একইসঙ্গে দেবাদিদেবের অঙ্গে স্থান পেয়ে আরও পবিত্র হন গঙ্গা। ভগীরথে নিজে শঙ্খ বাজিয়ে তাঁকে দিক নির্দেশ করে মর্ত্যে নিয়ে আসেন। কথিত আছে সেই দিনটি ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের দশমী। যা দশহরা তিথি হিসেবেও পরিচিত। তাই এইদিন ঘটা করে গঙ্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। এতে পূর্বপুরুষদের আত্মামুক্তির ইচ্ছাও পূরণ হয়। যেহেতু ভগীরথ গঙ্গার মর্ত্যাবতরণের প্রধান কারণ, সেই হেতু গঙ্গার অপর নাম ভাগীরথী।
আরও শুনুন: নিয়ম মানলে মেলে ফল, শাস্ত্রমতে কোন দিকে মুখ করে পুজো করা উচিত?
এছাড়া গঙ্গার অপর নাম জাহ্নবী। কথিত আছে, মর্ত্যে ভগীরথকে অনুসরণ করার সময় গঙ্গা ঋষি জহ্নুর আশ্রম প্লাবিত করেন। উগ্রতপা জহ্নু হয়ে গঙ্গার সমস্ত জল পান করে ফেলেন। তখন দেবগণ গঙ্গার মুক্তির জন্য ঋষির কাছে প্রার্থনা করতে থাকলে নিজের জঙ্ঘা বা জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্তি দেন। এইরূপে গঙ্গা জহ্নু ঋষির কন্যা রূপে পরিচিতা হন এবং তার অপর নাম হয় জাহ্নবী। তবে এইসবই কথিত আখ্যান। মর্ত্যে গঙ্গা দেবী রূপেই পূজিতা হন। হরিদ্বার, বারানসী সহ একাধিক স্থানে গঙ্গা মন্দির রয়েছে। নিয়মিত গঙ্গারতিও হয় এইসব স্থানে। আর এখনও হাজার হাজার হিন্দু পুন্যলাভের আশায় গঙ্গা স্নান করেন। তাঁদের সমস্ত পাপ,কালিমা নিজের শ্রোতের সঙ্গেই বয়ে নিয়ে যান গঙ্গা।