বছরে একবার মাসির বাড়ি যান প্রভু জগন্নাথ। সাতদিন আনন্দের সঙ্গে দিন কাটান। কিন্তু এই মাসির বাড়ি স্রেফ জনশ্রুতি মাত্র। আসলে মাসি নয়, পৌর্ণমাসীর বাড়ি যান জগন্নাথ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পৌর্ণমাসী আসলে কে? কেন এই বাড়িতেই যান প্রভু? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
রথে চড়ে মাসির বাড়ি যাবেন জগন্নাথ। শ্রীমন্দিরে সাজো সাজো রব। একইসঙ্গে সেজে উঠছে গুন্ডিচা মন্দির। সেখানেই তো সাত দিন থাকবেন প্রভু। কিন্তু এই গুন্ডিচা মন্দির আদৌ প্রভুর মাসির বাড়ি নয়! তাও এখানেই প্রভু যান অন্য কারও টানে।
আরও শুনুন: শুধুমাত্র জগন্নাথ নন, একই দিনে রথে চড়ে নগরভ্রমণে বেরোন মা তারাও
শ্রীমন্দির যেন দ্বারকার সিংহাসন। বছরভর সেখানে বসে রাজপাট সামলান দ্বারকাপতি শ্রী কৃষ্ণ। কলিতে তিনিই প্রভু জগন্নাথ দেব। কৃষ্ণ যেমন প্রজা পালন করতেন, তেমনই রত্নসিংহাসনে বসে ভক্তদের পালন করেন জগন্নাথ। আর মাসির বাড়ি যাওয়া আসলে তাঁর বৃন্দাবনধামে গমন। এই কদিন তিনি গোপীগণের সঙ্গ করবেন মহাপ্রভু। গুণ্ডিচা মন্দিরে শেষ তিনদিন তিনি রাসমণ্ডপে অধিষ্ঠান করবেন। গীতগোবিন্দম আবৃত্তি করে প্রভুর সন্তুষ্টি বিধান করবেন গোপীগণ। রথযাত্রার পরের এই সাতটা দিন জগন্নাথই সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ। আর গুণ্ডিচা মন্দির যেন পবিত্র বৃন্দাবনধাম। লোককথায় এই মন্দিরকে জগন্নাথের মাসির বাড়ি বলা হলেও, আসলে এই মাসি মায়ের বোন অর্থে নয়। বরং মাসি শব্দটি পৌর্ণমাসি থেকে এসেছে। এ বিষয়ে মাহেশ মন্দিরের সেবায়েত তমালকৃষ্ণ অধিকারী বলছেন,পৌর্ণমাসী ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের এক গোপী। অন্যান্যদের মতো তাঁর সঙ্গেই লীলায় মত্ত হতেন প্রভু। এবার কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবন থেকে দ্বারকায় রাজা হয়ে গেলেন, সেখানে আর গোপীগণ তাঁর সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ পেলেন না। দীর্ঘদিন কৃষ্ণকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন তাঁরা। সকলে মিলে হাজির হলেন দ্বারকা। কিন্তু চাইলেই তো আর রাজার দেখা পাওয়া যায় না। দ্বাররক্ষীরা প্রাসাদের ভিতরে অবধি ঢুকতে দিলেন না। তাই দ্বারকায় পৌঁছেও কৃষ্ণের দেখা পেলেন না গোপীগণ। মনের দুঃখে ফিরে এলেন নিজগৃহে। তবে কৃষ্ণ তো অন্তর্যামী। তিনি গোপীগণের মনের কথা জানতে পারলেন সহজেই। তখনই বললেন, প্রতি বছর রথযাত্রার পর সাতদিনের জন্য পৌর্ণমাসীর বাড়ি যাবেন কৃষ্ণ। সেখানে গোপীগণের সঙ্গে লীলায় মত্ত হবেন। সেই প্রথা মেনেই পুরীর জগন্নাথ হাজির হন পৌর্ণমাসীর বাড়ি। লোককথায় যা হয়ে গিয়েছে মাসির বাড়ি।
আরও শুনুন: উলটোরথ উপলক্ষে জগন্নাথ প্রভুর ‘সোনাবেশ’ দর্শনে উদগ্রীব থাকেন ভক্তরা
তবে পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরের সম্পর্কে আরও কিছু জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত আছে, পুরীর মহারাজ ইন্দ্রদুম্ন্য ও তাঁর স্ত্রীও এই মন্দিরের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে। আসলে রাজার স্ত্রী-র নামই ছিল গুন্ডিজা। তাঁকে উদ্দেশ্য করেই এই মন্দির তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে কথিত আছে দেব বিশ্বকর্মা যখন বন্ধ ঘরে জগন্নাথ মূর্তি তৈরি করছিলেন, গুন্ডিচাদেবী কোনওভাবে তা দেখে ফেলেন। এবং সেই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি দেখেই তিনি মোহিত হয়ে রাজাকে অনুরোধ করেন আরও একটি মন্দির নির্মানের জন্য। এমনটাও শোনা যায়, রাণী গুন্ডিচাই প্রথম রথযাত্রার প্রচলন করে বছরের নির্দিষ্ট সময় জগন্নাথের সেবার অবকাশ পেতে চান। তাঁর কথা মতোই তৈরি হয় গুন্ডিচা মন্দির। আবার অনেকে বলেন, গুন্ডিযা আসলে স্থানীয় এক দেবী। যিনি গুটি বসন্ত রোগের হাত থেকে ভক্তদের রক্ষা করেন। সবমিলিয়ে শ্রীমন্দিরের মতো গুন্ডিচা বাড়িও নানা রহস্য আর জনশ্রুতিতে ঘেরা। সে যাই হোক, প্রতিবছর রথের পর এই মন্দিরের গুরুত্ব যে শ্রীমন্দিরকেও ছাপিয়ে যায়, তা বলাই বাহুল্য।