কৃষ্ণের উৎসব। অথচ পূজিত হন কালী। দুর্গা, শিব, গঙ্গা আরও অনেকেই রয়েছেন। তাও আবার কোথায়, না, স্বয়ং গৌরাঙ্গধাম নবদ্বীপে। প্রতিবছর ধূমধাম করে রাস পালিত হয় সেখানে। তবে বৈষ্ণবদের রাস নয়, এ হল শাক্ত রাস। কী তার ইতিবৃত্ত? সন্ধানে শুভদীপ রায়।
দুর্গাপুজো শেষ। কালী ঠাকুর জলে পড়েছেন। বিদায় নিয়েছেন জগদ্ধাত্রীও। তবে ফেরত আসবেন আবার। পরের বছর নয়, চলতি বছরেই। মাঝে ব্যবধান মাত্র কয়েকদিনের। ফের রীতিমতো ঘটা করে পুজো হবে দেবীর এই সমস্ত রূপের। সিনেমা কিংবা গল্প নয়, বাস্তবের কথাই বলছি। প্রতিবছর এমন ছবি ধরা পড়ে, রাসের সময়। সবজায়গায় নয় অবশ্য। মূলত নবদ্বীপে।
রাস বলতেই শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে আসে। এমনটাই অবশ্য স্বাভাবিক। এ উৎসবের কেন্দ্রে স্বয়ং গোবিন্দ। কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় গোপীজনের সঙ্গে লীলায় মত্ত হন কৃষ্ণ। রাসলীলা বৈষ্ণব ভক্তগণের কাছে পবিত্র তো বটেই, ভারতীয় দর্শনেও এই রাসের আলাদা গুরুত্ব আছে। দেশের প্রায় সমস্ত বিষ্ণু মন্দিরেই রাস পালিত হয় ঘটা করে। কৃষ্ণ-রাধার মূর্তি সাজানো হয়। সঙ্গে থাকেন গোপীনিরাও। বাংলার ক্ষেত্রে শান্তিপুর, উলুবেড়িয়া-সহ অনেক জায়গাতেই রাস হয়। মেলা বসে। তবে ঠিক এইসময় নবদ্বীপের চেহারাটা খানিক আলাদা। এখানেও রাস হচ্ছে। তফাৎ স্রেফ ধরনে। অর্থাৎ এখানকার রাস শুধুমাত্র কৃষ্ণের নয়, রয়েছেন কালী, দুর্গা, গঙ্গা, শিব-সহ আরও অনেকে।
নিষ্ঠাভরে পুজো হয়। কোথাও আবার তন্ত্রমতে। কয়েকদিন ধরে পুজো চলে। এমন সুন্দর নৈবেদ্য সাজানো হয়, সেসব দেখার মতো ব্যাপার। দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন এইসময় ভিড় জমান নবদ্বীপে। মূর্তি হয় বিশাল। পুজো তো বটেই, বিসর্জনেও জাঁকজমক কম হয় না। এই শাক্ত রাস। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বৈষ্ণবদের নবদ্বীপে কেন শাক্ত রাস?
নবদ্বীপের পথে-ঘাটে মন্দির। বেশিরভাগই কৃষ্ণের। নিমাই-গৌরাঙ্গের স্মৃতিতে ভরা নগর। সেখানেই রয়েছে পোড়ামাতলা। কালী মন্দির, তবে জনপ্রিয়তা আর প্রাচীনত্বের নিরিখে সমস্ত মন্দিরকে টেক্কা দিতে পারে। এমনকি শক্তিসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তন্ত্রচর্চার মূল পীঠ ছিল এই নবদ্বীপ। সুতরাং এখানে শাক্ত রাস হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাও অনেকে বলেন নবদ্বীপে এই রাস আসলে বৈষ্ণব-শাক্ত বিরোধের ফল। বিষয়টা একেবারে ভুল নয়। তবে স্রেফ এই কারণেই শাক্ত রাস শুরু হয়েছিল, এমনটা ভাবা ভুল। আসলে, নবদ্বীপ যতটা বৈষ্ণবদের, ততটাই শাক্তদের।
পাল রাজাদের আমলে এখান বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। তন্ত্রচর্চার শুরু সেই বৌদ্ধদের হাত ধরেই। তবে সেকালে তন্ত্রচর্চা একটু অন্যরকম ছিল। মা কালী মোটেও গৃহীর দেবী ছিলেন না। শক্তি পূজা করতেন কাপালিকরা। সেই পুজোর ধরণ রীতিমতো ভয়ঙ্কর। আগমবাগীশের হাত ধরে এই ধারায় বদল এল। কালী হলেন মাতৃস্বরূপা। শাক্ত রাসের প্রচলনের নেপথ্যে এই সবকিছুকে কারণ হিসেবে ধরা যায়। আবার এমনটাও শোনা যায়, স্বয়ং রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে এই পুজোর শুরু। তাও প্রশ্ন ওঠে, বেছে বেছে কেন কার্তিক পূর্ণিমা? ব্যাখ্যা রয়েছে তারও।
শাস্ত্রমতে রাস পূর্ণিমা শক্তি পূজার জন্যও শুভ। একে মন্বন্তরা তিথি-ও বলা হয়। ব্রজের গোপীরা এই তিথিতেই দেবী যোগমায়া কাত্যায়নীর আরাধনা করে কৃষ্ণের সখ্যলাভ করেছিলেন। তাই এইসময় ঘটা করে শক্তির বিভিন্ন রূপের পুজো হয় নবদ্বীপে। একসময় বারোয়ারী আয়োজনে পুজো হত না। সকলের ঘরে আলাদা আলাদা ভাবে শক্তি আরাধনার চল ছিল। সেই ব্যবস্থা বদলায় সময়ের সঙ্গে। বড় মূর্তি গড়ে দেবীর পুজো শুরু নেপথ্যেও সেই কৃষ্ণচন্দ্র। যেখানে কৃষ্ণের পুজো হচ্ছে তার পাশেই ভয়ংকরী শ্যামা।
তন্ত্রমতে পুজো হচ্ছে দেবীর। পাঁঠা বলিও হত নবদ্বীপের এই রাসে। বর্তমানে একাধিক পুজো হয়। তবে বিশেষ এবং বিচিত্র কয়েকটি মূর্তি রয়েছে। প্রথমেই বড় শ্যামা। বিশাল কালীমূর্তি। ডাকের সাজে সজ্জিতা দেবী। গয়নাও অনেক। তেঘড়ি পাড়ার এই পুজো অত্যন্ত জনপ্রিয়। জাগ্রত দেবীর কাছে মানত করে যান অনেকেই। ভিড়ও হয় রীতিমতো। শ্যামার আরও অনেক রূপ পূজির হয় নবদ্বীপে। মূর্তির ধরণে তেমন পার্থক্য নেই। স্রেফ নাম আলাদা। রয়েছে, বামাকালী, রণকালী, কৃষ্ণকালী, আনন্দময়ী।
সবই দেবীর রূপ। শবশিবা পুজো এখানকার অন্যতম বিখ্যাত। কালী মূর্তিতে শিবের সঙ্গে শবের দেখা মেলে। আর কোথাও এই মূর্তি চোখে পড়ে না তেমন। এরপর দুর্গার অনুরূপ মূর্তি। নাম ভদ্রকালী। একইভাবে গৌরাঙ্গিনী মাতার মূর্তিও দুর্গা প্রতিমার মতোই। সঙ্গে আরও অনেক মূর্তি দেখা যায়। ভদ্রকালী, বিন্ধ্যবাসিনী, মহিষমর্দিনী উল্লেখযোগ্য। এখানেই শেষ নয়।
বর্তমানে তালিকায় ঢুকেছেন শিব, গঙ্গা, গণেশ, কার্তিক অনেকেই। গঙ্গাপুজো হয় বেশ কয়েক জায়গায়। রীতিমতো জাঁকজমকের সঙ্গেই আয়োজন হয় সবকিছুর। আবার ভারতমাতার পুজোও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে হালে।
তবে পুজোর চেয়েও আকর্ষণ বেশি বিসর্জনের। শোভাযাত্রা হয় দেখার মতো। শাক্তরাসের এই বিসর্জন যাত্রাকে ‘আড়ঙ’ বলা হয়। অনেক প্রতিমা ভক্তদের কাঁধে করে নগর পরিক্রমা করেন। সঙ্গে থাকে সেই পরিমাণ বাজনা। আলোর আয়োজনে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। গোটা নগরের বাসিন্দা এই দিন বাড়ির বাইরে থাকেন। প্রত্যেকের মনেই আলাদা উন্মাদনা। কেউ নাচছেন, কেউ গাইছেন, কেউ বা দেবী মূর্তির সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। বিসর্জনের আয়োজন দেখে পুরস্কারও দেওয়া হয়।
সেরা প্রতিমা, সেরা ঢাকি, এমনকি সাজের জন্যও পুরস্কার মেলে। খোদ রাজার আমলে এই পুরস্কারের রেওয়াজ শুরু হয়েছিল। তা বদলায়নি এখনও। তবে শোভাযাত্রার দিনে বিসর্জন হয় না অনেক প্রতিমাই। শহর ঘুরিয়ে দেবীরা আবার ফিরে যান মণ্ডপে। বিসর্জন পরদিন। সারিবদ্ধ ভাবে, একসঙ্গে জলে ফেলা হয় প্রতিমা। সেসব ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। রাসের প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যে দিয়েই নবদ্বীপের উৎসবের ইতি। আবারও এক বছরের অপেক্ষা। মা আসবেন শরতের মাঝেই, তবে নবদ্বীপ অপেক্ষা করবে আরও কয়েকটা দিন। রাসের জন্য। নবদ্বীপের নিজস্ব উৎসবের জন্য।