কয়েকহাজার কিমি উচ্চতায় অবস্থিত এক গুহা। তার মধ্যে বরফে ঢাকা শিবলিঙ্গ। বছরের অন্যান্য সময় সেখানে যাওয়াই দুস্কর। গুহায় প্রবেশ অসম্ভব। গ্রীষ্মকালে কয়েকদিনের জন্য ভিতরে যাওয়ার সুযোগ মেলে। আর তাতেই লাখো ভক্ত ভিড় জমান অমরনাথ দর্শনে। কিন্তু কেন? কী মাহাত্ম্য এই শিবলিঙ্গের? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
এ দেশে শিবমন্দিরের কমতি নেই। তার মধ্যে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এ ছাড়াও কিছু শিবমন্দির রয়েছে যেখানে পুজো দেওয়ার ইচ্ছা থাকে অনেকের। তবে ইচ্ছা থাকলেই সেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। প্রতিকূল পরিবেশ, দুর্গল পথ পেরিয়ে সেখানে যেতে পারেন না অনেকেই। এমনই এক শিবক্ষেত্র অমরনাথ। এ কোনও শিব মন্দির নয়। পাহাড়ি গুহার অন্দরে বরফে ঢাকা স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ।
আরও শুনুন: পুরীর মন্দিরের চার দরজা খোলার নির্দেশ বিজেপি সরকারের, কী গুরুত্ব এই চার দুয়ারের?
অমরনাথ যাত্রা কেবলমাত্র গ্রীষ্মকালেই হয়। তার জন্য আগেভাগে বিশেষ বুকিং সারতে হয়। এত দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ সরকারি অনুমতির। পথের ক্লান্তি সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু অবধি হয়েছে অনেকের। এছাড়া পাহাড়ি পথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা লেগেই থাকে। শুধু তাই নয়, অমরনাথ যাত্রায় বেশ কয়েকবার জঙ্গি হামলাও হয়েছে। সরকারের তরফে অবশ্য তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। তাও জীবন হাতে নিয়েই শিবের দর্শনে ছোটেন ভক্তরা। অমরনাথের মাহাত্ম্য নাকি এমনই। কথিত আছে, এই গুহায় একাধিকবার মহাদেবের দর্শন মিলেছে। সেই নিয়ে নানা কিংবদন্তি রয়েছে। কথিত আছে, এই গুহায় তপস্যা করেছেন ভৃগু, কশ্যপ-এর মতো মুনি ঋষিরা। কাজেই এই স্থানে একবার পৌঁছাতে পারাই পুন্যের বলে মনে করেন ভক্তরা। তবে অমরনাথ গুহার সঙ্গে অদ্ভুত কিছু অলৌকিক কাহিনিও জড়িয়ে। বলা হয়, গুহার অন্দরে এমন একজোড়া পায়রার দেখা মেলে, যারা আসলে অমর। স্বয়ং শিবের বরেই তাঁদের এই অবস্থা। অমরনাথে মাহাত্ম্য বর্ণনায় অবশ্যই বলতে হয় এই দুই পায়রার কথা।
আরও শুনুন: মহেশ্বরের উগ্র রূপ, মাঘের অষ্টমীতে কালভৈরব আরাধনায় মেলে বিশেষ ফল
অমরনাথ গুহার সৃষ্টি সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারেন না কেউই। কবে থেকে এই তীর্থ যাত্রা আরম্ভ সেই নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলেন এই গুহা আবিস্কার করেছিলেন মর্হষী ভৃগু। আবার কেউ বলেন অমরনাথ গুহা প্রকাশ্যে আসার নেপথ্যে আসল অবদান কশ্যপ মুনির। তবে পুরাণে এই গুহা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য রয়েছে। কথিত আছে, এখানেই মাতা পার্বতীকে সৃষ্টির আদিতত্ব বুঝিয়েছিলেন মহাদেব। সৃষ্টির সেই গোপন রহস্য আর কারও বোঝার অধিকার ছিল না। দুর্গম পথ পেরিয়ে পাহাড়ের এই নির্জন গুহায় সেই তত্ব সহধর্মিনীর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মহাদেব। যাওয়ার পথে একে একে, বাহন নন্দী, কপালে থাকা চাঁদ, গলার সাপ, সবকিছু ত্যাগ করেন মহাদেব। স্রেফ তিনি ও মাতা পার্বতী হাজির হন গুহায়। আর কেউ যেন এই তত্ব শুনতে না পায় তা নিশ্চিত করেই রহস্য ব্যাখ্যা আরম্ভ করেন মহেশ্বর। দৈবগুণে এই রহস্য যেই শুনবে তাঁর অমরত্ব প্রাপ্তি হওয়ার কথা। তাই সাধারণ কারও এ জিনিস শোনা নিষিদ্ধ। তবে মহাদেবের অলক্ষে সেদিন অমরনাথের গুহায় ঢুকে পড়ে দুটি পায়রা। নিয়মের কথা না জেনেই তারা মহাদেবের ব্যাখ্যা শুনে ফেলে। এই নিয়েও অবশ্য কিংবদন্তি রয়েছে। বলা হয়, শিবের ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে একসময় মাতা পার্বতী ঘুমিয়ে পড়েন। সেইসময় তাঁর হয়ে শিবকে প্রত্যত্তর দিতে থাকে দুই পায়রা। সমস্ত ব্যাখ্যা শেষ হলে ঘুমন্ত অবস্থায় পার্বতীকে আবিস্কার করেন মহেশ্বর। সেইসঙ্গে এও দেখেন যে সামনে দুটি ধবধবে সাদা পায়রা। ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে পায়রা দম্পতিকে হত্যা করতে উদ্যত হন মহাদেব। সেইসময় অমর হওয়ার দৈববাণী শিবকে মনে করায় দুই পায়রা। সেই শুনে শান্ত হন শিব। তবে পায়রা দম্পতি যেন ওই গুহা ছেড়ে আর কোথাও না যায়, সেই নির্দেশ দেন। সৃষ্টির আদি রহস্যের ব্যাখ্যা শুনে অমর হয় পায়রা দম্পতি। কিন্তু তারা নাকি আজও অমরনাথের গুহাতেই রয়েছে। যদিও এই তত্ব অনেকেই বিশ্বাস করেন না। কিন্তু কোনওভাবে অমরনাথের গুহায় জোড়া পায়রা দেখা গেলেই মনে করা হয় যুগ যুগ ধরে তারা সেখানেই রয়েছে। স্বয়ং শিবের আশীর্বাদ ধন্য এই গুহার সঙ্গে আরও কিংবদন্তি জড়িয়ে। এখানে পুজো দিয়ে সফল হয়েছেন, এমন কাহিনিও রয়েছে। তাই প্রতি বছর লাখো ভক্ত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হন অমরনাথ গুহায়।