আষাড় মাসের পূর্ণিমা। প্রভু জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রা দেবীর স্নানযাত্রা। এইদিন ১০৮ ঘড়া জলে স্নান করবেন মহাপ্রভু। আর তারপর প্রবল জ্বরে পড়বেন তিনজনেই। সারতে সময় লাগবে ১৪ দিন। লোকচক্ষুর আড়ালে এইকদিন প্রভুর জন্য বিশেষ সেবার ব্যবস্থা করা হয়। ঠিক কী হয় এই ১৪ দিনে? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
তিনি জগতের নাথ। তিনি অনিমিষ। জগতের কোনওকিছুই তাঁর চোখের আড়াল হয় না। শ্রীক্ষেত্র সহ দেশের বিভিন্ন মন্দিরে সারা বছর প্রভুর আরাধনা চলে। তবে রথযাত্রার গুরুত্ব একেবারেই আলাদা। জগন্নাথ ধাম পুরীর বার্ষিক উৎসব এই রথযাত্রা। তবে উৎসবের শুরুটা হয়ে যায় তার দিন পনেরো আগেই, প্রভুর স্নান যাত্রার মাধ্যমে।
আরও শুনুন: সাতদিনের জন্য মাসির বাড়ি থাকেন জগন্নাথ, কী বিশেষত্ব পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরের?
জগন্নাথ প্রভুর অপূর্ব লীলামাধুরী প্রকাশের ক্ষণ স্নানযাত্রা। আয়োজনও তেমনই মনোরম। প্রায় সমস্ত জগন্নাথ মন্দিরের স্নান যাত্রার আয়োজন করা হয়। যার মধ্যে শ্রীক্ষেত্রের আয়োজন লক্ষণীয়। এদিন রত্ন সিংহাসন থেকে নেমে আসেন প্রভু জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম। মন্দির সংলগ্ন স্নানবেদীতে হয় মহাপ্রভুর প্রত্যক্ষ স্নান। জল আনা হয় ‘স্বর্ণ কুণ্ড’ থেকে। কুণ্ডটি শ্রীমন্দিরের ভেতরেই অবস্থিত। সুদর্শন ও ত্রিমূর্তি-কে ১০৮ কলসি জলে স্নান করানো হয়। ‘স্কন্দপুরাণ’-এ উল্লেখ রয়েছে, স্বয়ং শ্রীজগন্নাথ ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজকে বলেছিলেন, ‘আমার আবির্ভাব দিবস জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমাতে আমাকে বাইরে, মণ্ডপের উপর নিয়ে গিয়ে ভক্তিভাবে আদর-যত্নে মহাস্নান করাবে।’ সেই আদেশ পালনের পরম্পরা এখনও প্রচলিত। জনশ্রুতি আছে, আগে এই উৎসবটির জন্যে ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান থেকে পবিত্র জল আনা হত। বৈষ্ণব মতে ঠাকুরের যাত্রার আগে তাঁর রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য ঝাড়ু দেওয়া হয়। মহাপ্রভু জগন্নাথের প্রথম সেবক হিসেবে পুরীর মহারাজ ঠাকুরের জন্য রাস্তা পরিষ্কার করেন। এই একই প্রথা আমরা দেখতে পাই রথযাত্রা ও উল্টোরথের সময়। মহাপ্রভু আসীন হওয়ার পর চতুর্ধা মূর্তি স্নান করেন। স্নানযাত্রার শেষ পর্বে আসে সেই বিশেষ ক্ষণ, যখন গজানন বেশে ভক্তদের দর্শন দেন ভক্তের ভগবান। ভক্তকুলকে দর্শন দিয়ে, স্নানান্তে অসুস্থ হওয়ার মতো আরও একটি লৌকিক সত্যকে গ্রহণ করে জগন্নাথ মহাপ্রভু ১৪ দিনের জন্যে লোকচক্ষুর আড়ালে নিভৃতবাস যাপন করেন।
আরও শুনুন: স্বয়ং কৃষ্ণের লীলার সঙ্গে যোগ, প্রভু জগন্নাথকে কেন ৫৬ ভোগ দেওয়া হয় জানেন?
করোনা মহামারী আমাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শিখিয়েছিল। আক্রান্তদের এই কদিনে লোকচক্ষুর আড়ালে কাটাতে হত। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেও মানতে হত বিশেষ নিয়ম। অথচ করনো আসার অন্তত হাজার দুই বছর আগে জগন্নাথের লীলায় সে নিয়ম প্রকাশ পেয়েছে। পুরীর মন্দিরে জগন্নাথের এই ১৪ দিনের নিভৃতযাপনকে ‘অনাসর’ বলা হয়। শ্রীক্ষেত্রের মতো একই নিয়ম রয়েছে দেশের অন্যান্য জগন্নাথ মন্দিরেও। বাংলার সুপ্রাচীন জগন্নাথ মন্দির মাহেশেও একইভাবে স্নানযাত্রার পর নিভৃতবাস কাটান জগন্নাথ। এই সময় মহাপ্রভুর বিগ্রহে তাপ অনুভব করেন সেবায়েতরা। ঠিক যেমনটা কারও জ্বর এলে হয়। তা সারানোর জন্য বিশেষ পথ্য দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে দিনরাত সেবা চলে মহাপ্রভুর। অন্দরে কী হচ্ছে তা দেখার অধিকার নেই কারও। সেবায়েতদের মধ্যেও সকলে এই সুযোগ পান না। এইসময় চতুর্ধা মূর্তিতে বিশেষ এক তেল মাখানো হয়। বিভিন্ন ভেষজ দিয়ে তৈরি এই তেল প্রভুর পথ্য বলা যায়। ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় ‘পাঁচন’। সেখানেও নানা ঔষধি মেশানো থাকে। মাহেশের মন্দিরে জগন্নাথের জ্বর সারাতে দূর দুরান্তের কবিরাজরা এসে উপস্থিত হন বলে জানা যায়। বাংলার কিছু মন্দিরে এইসময় প্রভুর অঙ্গরাগও হয়। সবমিলিয়ে ১৪ দিন ধরে গুপ্তভাবেই প্রভুর অর্চনা ও সেবা চলে। তারপরই রাজবেশে জগন্নাথের আবির্ভাব। রথে চড়ে মাসির বাড়ি যাবেন প্রভু। ভক্তকুল অপার বিস্ময়ে সেই লীলা প্রত্যক্ষ করবেন।