পুরাণের গল্প হোক কিংবা শাস্ত্রের ব্যাখ্যা। দেবী কালীর রূপ বর্ণনা করতে গেলে সবসময় রুদ্ররূপের ছবিই সামনে আসে। যেখানে দেবী অবশ্যই কোনও রাক্ষস প্রবৃত্তি দমনে ব্যস্ত। অথচ তিনি তো মায়েরই আরেক রূপ। তাই চেহারায় সংহার ভাব প্রকট হলেও, মা কালীর এক বিশেষ রূপ রক্ষা করেন শিশুদের। কে সেই দেবী? আসুন শুনে নিই।
ধ্যানমন্ত্র বলে, তিনি ঘোর কৃষ্ণকায়। অথচ তাঁর রূপের ছটায় অন্ধকারেও চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বাধ্য। কখনও শ্মশানবাসী, কখনও রাজ রাজাদের গৃহদেবী। মা কালীকে এমনই একাধিক রূপে আমরা চিনি। কিন্তু একটি শিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন রুদ্ররূপী দেবী এমনটা কখনও দেখেছেন? তিনিও দেবী কালীর আরেক রূপ। কিন্তু তাঁর প্রধান পরিচয় শিশুদের রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে।
আরও শুনুন: নারায়ণ পুজোয় দিতেই হয় তুলসী পাতা, নেপথ্যে পুরাণের কোন গল্প?
নিশ্চয়ই ভাবছেন, দেবী কালীর মূর্তিতে শিশু কোথা থেকে আসবে? বরং এমন মূর্তি তো দেখা যায় মা ষষ্ঠীর ক্ষেত্রে। বাঙালিদের কাছে তিনিই তো শিশুদের রক্ষাকর্ত্রী। একথা অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই। বরং মা ষষ্ঠীকেও প্রকারন্তরে দেবী কালীর রূপ বলাই যায়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে সত্যিই একটি কালী মন্দির রয়েছে, যেখানে বিগ্রহ এমনই। এই দেবী দক্ষিণের মানুষের কাছে ‘পেরিয়াছি আম্মা’ নামেই পরিচিত। কেউ কেউ আবার সেই নামের মাঝে কালী-ও জুড়ে দেন। তবে দেবীর এই বিশেষ রূপ নিয়ে এক প্রচলিত কাহিনি শোনা যায়। যার থেকেই পরিষ্কার হয় দেবীর এহেন শিশু রক্ষার কারণ।
জনশ্রুতি মতে, এই অঞ্চলে পেরিয়াছি আম্মা একজন সাধারণ মহিলা হিসাবেই ছিলেন। যিনি গ্রামে-গঞ্জে দাই মা বা ধাত্রীমাতা হিসাবে কাজ করতেন। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি যে শিশুদের বিশেষ নজরে দেখবেন, এ কথা বলাই বাহুল্য। তা সেই সময় তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন, যে রাজার ঘরে নতুন শিশুর জন্ম হলেও ডাক পড়ত এই পেরিয়াছি আম্মার। একইসঙ্গে তাঁর বেশ কিছু লড়াইয়ের কায়দা জানা ছিল। অনায়াসে খালি হাতে তিন চার জনকে ঘায়েল করে দিতে পারতেন তিনি। তাই সকলেই তাঁকে বেশ সমীহ করে চলত। একবার কোনও এক বিদেশি শত্রুর আক্রমণে তাদের রাজা পরিবারের সকলকে নিয়ে জঙ্গলে এসে আশ্রয় নেন। শোনা যায়, সেই সময় রাজার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। কিছুদিন পরই তাঁর প্রসববেদনা ওঠে। এদিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রসব করানোর ঝুঁকি নেবে কে? ডাক পড়ে পেরিয়াছি আম্মার। এদিকে সেই রাজা ভীষণভাবে জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন। জনৈক জ্যোতিষী তাঁকে বিধান দিয়েছিল, তাঁর দুর্দশা কাটবে নতুন সন্তানের জন্মের পরেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে নবজাতকের জন্মের সময় কোনও ভাবে তার শরীর যেন মাটিতে না ঠেকে তা লক্ষ রাখতে হবে। একইসঙ্গে জ্যোতিষী রাজাকে বিধান দেন, সদ্যোজাতকে জন্মের পরই বলি দিতে হবে। যে বা যারা তাকে জন্মের পর ছোঁবে তাদেরও বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। প্রসবের আগে প্রথম শর্তের কথা বললেও, পেরিয়াছি আম্মা কে পরের দুটি শর্ত জানাননি রাজা। যদিও প্রথম শর্তটি মেনে প্রসব করানোও বেশ কঠিন ছিল পেরিয়াছি আম্মার কাছে। তবু অদ্ভুত উপায়ে তিনি সে কাজ সম্ভব করে তোলেন। জনশ্রুতি মতে, তখনকার দিনেই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু কায়দা ব্যবহার করে শিশুটির প্রসব করিয়েছিলেন পেরিয়াছি। কিন্তু নবজাতকের জন্মের পরই জ্যোতিষের কথামতো শর্ত পালনে উদ্যত হন রাজা। তলোয়ার বার করে সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির দিকে এগিয়ে যান। রাজার হাতে তলোয়ার দেখেই সব বুঝে যান পেরিয়াছি। তখনই অদ্ভুত কৌশলে নিজের দুই পায়ের মাঝে রাজাকে চেপে ধরেন তিনি। ততক্ষণ অবধি ধরে থাকেন যতক্ষণ না রাজার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। অন্যদিকে, স্বামীর এমন অবস্থা দেখে আম্মাকে বাধা দিতে উদ্যত হন রানিও। অথচ, তখন তিনি পেরিয়াছি আম্মার কোলের শুয়ে আছেন। বাধা পেয়ে আরও রেগে যান আম্মা। মুহূর্তের মধ্যে রানির পেট চিরে তাঁকে হত্যা করেন তিনি। এই এত কিছু করার সময় সদ্যোজাতকে একবারের জন্যেও মাটিতে নামিয়ে রাখেননি তিনি। তাকে এক হাতে ধরেই এমন দুঃসাহসিক যুদ্ধ করেন তিনি। সেই থেকেই তিনি শিশুদের রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মৃত্যুর পর তাঁর সেই সংহার মূর্তিই প্রতিষ্ঠা করেন অনেকে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন মন্দিরও।
আরও শুনুন: পৌষ মাসে মুলো দিয়ে মা কালীর পুজো দেওয়া হয়, নেপথ্যে কোন কারণ?
তবে এ তো গেল জনশ্রুতি। এর সঙ্গে দেবী কালীর সম্পর্কটা ঠিক কোথায়? এ প্রশ্নের একেবারে সঠিক উত্তর হয়তো নেই। তবে অনেকেই মনে করেন দস্যুদের হাত থেকে হিন্দু মন্দির রক্ষা করার জন্য অনেক লৌকিক দেব-দেবীর কাহিনির উপরেই দৈবের প্রলেপ চাপানো হয়েছিল। পেরিয়াছি আম্মাও সেই ভাবেই হয়ে উঠেছেন রুদ্ররূপী কালীর অংশ। হয়তো পুরাণে দেবী কালীকার সঙ্গে এমন দেবীর কোনও উল্লেখ পাওয়া যাবে না। তবে যে কোনও দেবীই যে ‘মা’। তাই তিনি তাঁর সন্তানকে রক্ষা করবেন একথা বলাই বাহুল্য।