দূর থেকেই ভেসে আসছে জুঁইয়ের সুবাস। একটু এগোলেই কানে আসছে বাঁশির সুর। হরিনাম সংকীর্তনের ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত । ভাবছেন তো, কোনও কৃষ্ণ মন্দির বা বৈষ্ণব মঠে প্রবেশের বিবরণ দিচ্ছি। একেবারেই তা নয়। বরং এই অভিজ্ঞতা হবে এক কালী মন্দিরে পা রাখলে। সাধারণ কালী মূর্তির থেকে একেবারে আলাদা সেই দেবীর রূপ। সবুজকালীর মাহাত্ম্যকথা শোনালেন শুভদীপ রায়।
ধ্যানমন্ত্রে দেবীর কালীর নির্দিষ্ট রূপের বর্ণনা মেলে। সেখানে তিনি, করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, মুণ্ডমালা বিভূষিতা। এই দেবীর রূপও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে কালী মূর্তির গাত্রবর্ণ হিসেবে আমরা যে দুটি রং কল্পনা করে থাকি, এই দেবীর গাত্রবর্ণ একেবারেই তা নয়। অর্থাৎ এই দেবী কালো কিংবা নীল বর্ণের নয়। দূর্বার ন্যায় সবুজ বর্ণের।
হুগলি জেলার সুপ্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রাম হরিপাল। এই অঞ্চলের একটি ছোট জনপদ শ্রীপতিপুর। এই গ্রামের অধিকারী পরিবারেই দীর্ঘদিন যাবৎ পূজিতা মা সবুজ-কালী। যদিও দেবীর এমন রূপের নেপথ্যে অবশ্য এক অলৌকিক কাহিনিই রয়েছে। এই পরিবার বৈষ্ণবমতে দীক্ষিত। বাড়িতেই নিত্য সেবা পান নারায়ণ। এমন এক পরিবারে কালীপুজো হওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। দেবীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বটকৃষ্ণ অধিকারী। বর্তমানে তাঁর সুযোগ্য পুত্র কালিপদ অধিকারী মন্দিরের প্রধান সেবায়েত। তবে মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিস্তারিত ভাবে শোনাচ্ছেন বটকৃষ্ণের পৌত্র দেবজ্যোতি অধিকারী। বর্তমানে তিনিই মন্দিরের আহ্বায়ক। কালী-মন্দিরের নেপথ্য আখ্যান জানিয়ে তিনি বললেন,
দেবীর এই রূপ স্বপ্নে দেখেছিলেন তাঁর পিতামহ বটকৃষ্ণ। যেন কৃষ্ণ এবং কালী একইঅঙ্গে বিরাজ করছেন। যাঁর গাত্রবর্ণ সবুজ। ঠিক কচি দূর্বা ঘাসের মতো। সেই নবদূর্বাদল শ্যাম মায়ের মূর্তি বাংলার ১৩৫৭ সালে রটন্তী কালী পুজোর দিন প্রতিষ্ঠিত হলেন এই গ্রামে।
আরও শুনুন: নিজে থেকেই রূপ বদলান দেবী, কোথায় রয়েছে এমন আশ্চর্য মন্দির?
দেবীর পুজো হয় গুহ্য তন্ত্রমতে। দেবী পূজার আসন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে পঞ্চ মুণ্ডির আসন। তবে বৈষ্ণব বাড়িতে বলিপ্রথার চল নেই। এখানে দেবী কালীও পরম বৈষ্ণব। বিগ্রহের কপালে বৈষ্ণব তিলক তার প্রমাণ দেয়। যদিও এই দেবীকে আমিষ ভোগ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। দেবীর প্রিয় ভোগ ইলিশ মাছের পদ। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময় দেবীকে ইলিশ মাছের ভোগ দেওয়া হয়। এছাড়া নিত্যপুজোতেও আমিষ ভোগ নিবেদনের নিয়ম রয়েছে। দেবীর পুজো ফুল জুঁই। স্বয়ং বামদেবের সঙ্গেও এই পরিবারের যোগ রয়েছে। গুরু সূত্রে সেই সৌভাগ্য হয়েছিল মন্দিরের প্রধান সেবায়েত কালীপদর। মায়ের মন্দিরে বামদেবের ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী এখনও রয়েছে।
তবে এই দেবীর পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য বাঁশি। পুরনো রীতি মেনে এখনও মাকে বাঁশি বাজিয়ে শোনান মন্দিরের সেবায়েতরা। মায়ের পুজো শুরু হয় মঙ্গলারতির মাধ্যমে। বেলায় হয় নিত্যপুজো। সেইসঙ্গে নিবেদন করা হয় ভোগ। আর সন্ধেবেলা আরও একবার দেবীর পুজো হয়। তবে বৈশাখ মাসে তিনবার নয়, দেবীর পুজো হয় দিনে চারবার। এক্ষেত্রে গ্রীষ্মকালীন মরশুমি ফল দেওয়া হয় দেবীকে।
আরও শুনুন: নাড়ির স্পন্দন পেলে তবেই চলে, বিগ্রহের হাতেও দিব্যি সক্রিয় ‘অলৌকিক’ ঘড়ি
ঠিক কীভাবে এই মন্দিরে পৌঁছাবেন?
হাওড়া থেকে তারকেশ্বরগামী ট্রেনে নালিকুল ষ্টেশনে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে অটোয় মিনিট দশেক। এলাকায় এই দেবী মন্দির যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাই প্রায় সকলেই এই মন্দির চেনেন। আবার ধর্মতলা থেকে সড়কপথেও আসা যায় এই মন্দিরে। প্রতি অমাবস্যাতেই দেবীর বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। সেসময় দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা এসে ভিড় জমান মন্দিরে। তবে বছরের তিনটি অমাবস্যায় মন্দিরে ভিড় থাকে চোখে পরার মতো। প্রথমেই রটণ্ডী চতুর্দশীতে মন্দির প্রতিষ্ঠা দিবসের পুজো। এরপর ফলহারিনি কালীপুজো এবং দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন মন্দিরে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা হয়। স্রেফ রূপের ফারাক নয়, দেবীর মাহাত্ম্যও কিছুমাত্র কম নয়। ভক্তিভরে স্মরণ করলে তিনি মনস্কামনা পূর্ণ করেন। আর সেই আশা নিয়েই দূর দূরান্তের ভক্তরা মন্দিরে ছুটে আসেন।