পদতলে মহাদেব। তাই জীভ কেটেছেন স্ত্রী ‘শ্যামা’। কালীমূর্তির লোলজিহ্বা সম্পর্কে, প্রচলিত ধারণা এটিই। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও ব্যাখ্যাও? আসুন শুনে নিই।
তিনি মহাবিদ্যার অংশ। তবু দেবী কালীকে নিজের কন্যারূপেই দেখেছেন বহু সাধক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা কালীমন্দির ঘিরেও প্রচলিত হয়েছে নানান কিংবদন্তি। একইসঙ্গে কালীর বিশেষ রূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধারণা। দেবীর লোলজিহ্বার প্রচলিত বাখ্যাটিও খানিক তেমনই।
আরও শুনুন: রক্তজবা ছাড়া হয় না কালীপুজো, দেবীর পায়ে আর কোন কোন ফুল দেওয়া যায়?
একসময় সাধারণ গৃহস্থ ঘরে কালীপুজোর তেমন চল ছিল না। এমনকি দেবীর কোনও মূর্তিও ছিল না। কেবলমাত্র শ্মশান কিংবা গভীর অরণ্যের নির্জনতাকেই কালীপূজার উপযুক্ত স্থান হিসেবে ধরা হত। আর সাধানা করতেন তান্ত্রিকরা। কখনও প্রদীপ জ্বালিয়ে আবার কখনও শিলাখণ্ড সামনে রেখেই চলত মাতৃ আরাধনা। এদিকে কালীর ধ্যানমন্ত্রে স্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে দেবীর রূপের। অথচ সেই ব্যাখ্যা মেনে মূর্তি তৈরি করেননি কেউই। প্রথমবার শিলাখন্ড ছেড়ে মায়ের মূর্তি স্বচক্ষে দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠলেন মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তাঁর সেই আকুলতায় সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেননি স্বয়ং দেবীও। গ্রাম্যবধূর রূপেই তিনি ধরা দিয়েছিলেন সাধক কৃষ্ণানন্দের সামনে। আর তারপর ধীরে ধীরে কৃষ্ণানন্দের হাত ধরে শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠলেন বাংলার আদরিণী শ্যামা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই মূর্তিতেও দেবীর লোলজিহ্বা কেন হল?
আরও শুনুন: রক্ষাকালী, শ্যামাকালী, দক্ষিণাকালী… কোন বৈশিষ্ট্যে বদলে যায় মা কালীর রূপ?
একথা বলার আগে জেনে নেওয়া যাক, ধ্যানমন্ত্রে দেবীর রূপ বাখ্যা ঠিক কেমন। সেই বর্ণনা অনুযায়ী, দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তিনি চতুর্ভূজা। বামকরযুগলে স্থান পায় সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ। আর দক্ষিণকরযুলে দেবী বর ও অভয় মুদ্রা প্রদান করেন। দিগম্বরী এই দেবীর গাত্রবর্ণ মূলত কালো। সেইসঙ্গে তিনি লোলজিহ্বা। ধ্যানমন্ত্র অনুসারে , দেবী দাঁত দিয়ে সেই জিভ কামড়ে ধরে রেখেছেন। দেবীর ভীষণরূপের ক্ষেত্রে সেই লোলজিহ্বা আলাদাই মাত্রা যোগ করে। তবু তিনি তো মহাদেবের স্ত্রী। তাই সেই প্রসঙ্গ টেনেই অনেকে মনে করেন দেবী হয়তো লজ্জায় জিভ বের করেছেন। কিন্তু শাস্ত্রীয় ব্যখ্যা ঠিক তা নয়। আসলে কালী শক্তিস্বরূপা। সেই হিসেবে তিনিও দেবী চামুণ্ডার রুপ। তাই শাস্ত্রজ্ঞরা মনে করছেন, চামুণ্ডা যেমন অসুরের রক্ত পান করতে জিভ বার করেছিলেন। কালীও সেই কারনেই লোলজিহ্বা। তবে আগমবাগীশ যে মাতৃমন্দির গড়েছিলেন তার লোলজিহ্বার সঙ্গে সেই লজ্জার প্রসঙ্গই জড়িয়ে।
শোনা যায়, এমন সময় কোনও এক ভোররাতের স্বপ্নে আচমকা ঘুম ভাঙে তন্ত্রসাধক আগমবাগীশের। তাঁর মনে হয় কেউ তাঁকে বলছে, এই ভোরের প্রথম আলোতেই তিনি নাকি খুঁজে পাবেন নিজের আরাধ্য দেবীর রূপ। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেন সাধক। কিছুদুর হেঁটেই তিনি পৌঁছান এক গ্রামে। সেই ভোরের আলোয় তিনি দেখেন, সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জনৈক শ্যামবর্ণা গ্রাম্যবধূ। পরনে খাটো কাপড়, নিজের ডান পা সামনের দিকে এগিয়ে দেওয়ালে মাটি দিচ্ছেন সেই মহিলা। তাঁর ঘন কালো চুল কোমর ছাড়িয়ে ঢেকে রেখেছে তাঁর পিঠ। হঠাৎ করে পরপুরুষকে সামনে দেখতে পেয়ে অপ্রস্তুতে পড়েছেন তিনিও। অজান্তে কোনও ভুল করলে আমরা যেভাবে জিভ বের করে ফেলি, সেই মহিলাও তেমনটাই করে ফেলেছেন। এমন দৃশ্য দেখেই কৃষ্ণানন্দের মনে পড়ে যায় তন্ত্রে বর্ণিত দেবী কালীর ধ্যানমন্ত্র। সাধক বুঝতে পারেন ভোরের সেই দৈববাণী মিলে গেছে। এই মহিলাই তাঁর আরাধ্যার প্রতিরূপ। সেদিন করজোড়ে সেই দেবীকে প্রণাম করে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন কৃষ্ণানন্দ। তারপর একাগ্র মনে সেই দৃশ্যকে কল্পনা করেই তন্ত্রাচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ গড়েছিলেন দেবী দক্ষিণাকালীর মুর্তি। আজ থেকে আনুমানিক ৫০০ বছর আগে নবদ্বীপের জঙ্গলাবৃত দ্বীপে এভাবেই তৈরি হয়েছিল আজকের ঘরে ঘরে পূজিত ও প্রচলিত শ্যামা তথা কালীমূর্তি।