সূর্যাস্তের পর কোনও মানুষের প্রবেশের অধিকার নেই এই উপবনে। এমনকি পশুপাখিরাও নাকি এখানে রাত কাটায় না। অন্ধকারের আড়ালে এখানে নেমে আসেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, এমনটাই বিশ্বাস ভক্তদের। আসুন, শুনে নেওয়া যাক বৃন্দাবন লাগোয়া এই রহস্যময় অরণ্যের কথা।
বৈষ্ণব পদাবলি জানায় কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার অপার্থিব এক প্রেমের কাহিনি। যে প্রেমে সমাজ সংসার তুচ্ছ করে প্রেমিক কৃষ্ণের উদ্দেশে অভিসারে যান রাধা। সেই মিলনের সাক্ষী থাকে রাতের আঁধার আর গহন অরণ্য। কৃষ্ণভক্তরা বিশ্বাস করেন, আসলে বৃন্দাবনের কাছেই ছিল মধুবন নামের সেই অরণ্য, যেখানে মিলিত হতেন রাধাকৃষ্ণ। বর্তমানে বৃন্দাবন লাগোয়া নিধিবন বা নিধুবনকেই সেই প্রাচীন মধুবনের মর্যাদা দেন তাঁরা। তাঁরা মনে করেন, এখনও রাতের অন্ধকারে সেই উপবনে আবির্ভাব ঘটে শ্রীকৃষ্ণের। জেগে ওঠে দ্বাপর যুগের সেই প্রাচীন মধুবন। আর সেই কারণেই সন্ধ্যার পর এই বন কিংবা বনের ভিতরে থাকা মন্দিরে কারও প্রবেশ করা নিষেধ। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রহস্য যেন ঘিরে রয়েছে এই নিধিবনকে। কীরকম? আসছি সে কথাতেই।
আরও শুনুন: অস্ট্রেলিয়াতে গড়ে তুলেছেন আস্ত বৃন্দাবন, ভিনদেশি কৃষ্ণভক্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ প্রধানমন্ত্রী
কেবল মুখের কথা নয়। সন্ধ্যা নামলে আর প্রবেশ করা যাবে না এই বনে, এমনই সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে নিধুবনে। সঙ্গে প্রচলিত হাজারও জনশ্রুতি। যা বলে, এই নিষেধ যারাই অমান্য করার সাহস দেখিয়েছে, তারা সকলেই নাকি বিকলাঙ্গ বা উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি নাকি ঘটেছিল এক বাঙালিকে কেন্দ্র করেই। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি লুকিয়ে ছিলেন বনে। পরদিন সকালে মন্দিরের সেবায়েতরা এসে আবিষ্কার করেন তাঁকে। অচৈতন্য অবস্থায়। চিকিৎসা করলেও বাকশক্তি আর ফিরে আসেনি তাঁর। কয়েকদিনের মধ্যেই মৃত্যুও ঘটে ওই ব্যক্তির। কিন্তু মৃত্যুর আগে একটি চিঠিতে স্পষ্ট বাংলায় তিনি লিখে যান, নিধিবনে নাকি স্বয়ং কৃষ্ণকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। বলাই বাহুল্য, ভক্তরা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করেন সে কথা। মথুরার সরকারি সংগ্রহশালাতেও ঠাঁই পেয়েছে সেই চিঠিটি।
আরও শুনুন: যত গোপী তত কৃষ্ণ… এর ভিতরই লুকিয়ে আছে রাসলীলার মাধুর্য
এই উপবনের মধ্যে রয়েছে বাঁকেবিহারী মন্দির, যেখানে রয়েছে কষ্টিপাথরে তৈরি কৃষ্ণের মূর্তি। আর সেই কৃষ্ণই নাকি প্রতি রাতে পা রাখেন এই নিধিবনে, এমনটাই বিশ্বাস ভক্তদের। নিধিবনে যে আশ্চর্য গাছগুলি দেখা যায়, যেগুলির মাটির দিকে অবনত ডালপালা দেখলে প্রণামের ভঙ্গি মনে আসে, ভক্তদের মতে তারা সকলেই ছদ্মবেশী গোপিনী। প্রতি রাতের রাসলীলায় নাকি যোগ দেন এই গোপিনীরাও। এ ছাড়াও নিধিবনে রয়েছে রংমহল। ভক্তদের বিশ্বাস, রাসলীলার শেষে এখানেই রাধার সঙ্গে বিশ্রাম নেন কৃষ্ণ। তাই রংমহলে রয়েছে চন্দনকাঠের পালঙ্ক। প্রতিদিন মন্দির বন্ধের আগে ভোগ, মুখশুদ্ধি, দাঁতনকাঠি আর রাধার জন্য প্রসাধনসামগ্রী গুছিয়ে রংমহলে রেখে যান সেবায়েতরা। শোনা যায়, ভোরে মন্দির খোলার পর সেই সবকিছুকেই নাকি ব্যবহৃত অবস্থায় দেখতে পান তাঁরা।
বিশ্বাস আর যুক্তির তর্ক তো চলেই। তবে এই দুয়ের মাঝখানে রয়ে যায় এক রহস্য। তেমন রহস্যের আবরণেই মোড়া বৃন্দাবনের নিধিবন।