স্বামীজি যে ধর্মভাবনাকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন, তার মূল কথাই ছিল সামনে এগিয়ে যাওয়া। ভারতীয় ধর্মের সূত্রেই তিনি এমন একটি সূত্র খুঁজতে চেয়েছিলেন, যা একটা দেশকে আগামীর পথে বহুদূর এগিয়ে দেবে, সনাতনের সন্ধানে পিছিয়ে দেবে না। আজ যখন ধর্মভাবনাকে আমরা ধর্মস্থান, আচার-বিচার-সংস্কারেই আটকে ফেলছি ক্রমাগত, তখন আসলে খাটো করে ফেলছি স্বামীজির ভাবনাকেও। ধর্ম নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের সেই ভাবনাকেই ফিরে দেখলেন সরোজ দরবার।
ধর্মকে কোনও একটি নির্দিষ্ট মত বলে ভাবতে চাননি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কাছে ধর্ম ছিল অন্তরের জিনিস, নিগূঢ় চেতনা। তাঁর ভাবনায় ধর্মের অনুভব যেন ছিল ‘নূতন অন্তরিন্দ্রিয়’, যা কিনা আত্মোপলব্ধিতে পৌঁছে দেয় ব্যক্তিকে। তাঁরই সমকালে, ধর্মকে আরও বৃহত্তর পরিসরে সম্যক রূপে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, উত্তরকালে যিনি স্বামী বিবেকানন্দ; তিনিও ধর্মের ভিতর নূতন একটি তরঙ্গেরই সন্ধান করেছিলেন, জানিয়েছিলেন- ‘প্রাচীন ধর্ম শুধু নূতন কেন্দ্র-সহায়েই নূতনভাবে সঞ্জীবিত হইতে পারে।’ এবং রবীন্দ্রনাথ যে ধর্মকে নির্দিষ্ট মত না ভেবে অন্তরের সজীব পদার্থ হিসাবে ভাবতে চেয়েছিলেন, বিবেকানন্দও যেন সে-কথাই বলছেন। তিনিও চাইছিলেন ধর্মের জাগরণ, এবং দ্বিধাহীন তাই বলে উঠতে পেরেছিলেন, ‘গোঁড়া মতবাদ সব গোল্লায় যাউক- উহাদের দ্বারা কোনও কাজই হয় না।’ ধর্ম আর জীবন সংযুক্ত হয়ে একটি সতেজ, সবেগ জাতির স্বপ্ন ছিল তাঁর।
বর্তমানে ধর্ম নিয়ে যা চর্চা, তা যেন ক্রমশ পশ্চাদগামী। পাঁচশ কি হাজার কি তার থেকেও বেশি পুরনো সময়ে গিয়ে হয়তো গৌরব খুঁজে আনতে হচ্ছে। এবং তাই-ই সন্তোষজনক এরকম একটা প্রচার ক্রমাগত চলতে চলতে মতবাদ হয়ে উঠছে। তা ঠিক কি ভুল, সে প্রসঙ্গ আলাদা। তবে সেই অতীতগামিতার সঙ্গে আর যাই হোক বিবেকানন্দের নাম জোড়া চলে না। স্বামীজি যে ধর্মভাবনাকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন, তার মূল কথাই ছিল সামনে এগিয়ে যাওয়া। ভারতীয় ধর্মের সূত্রেই তিনি একটি জাতীয়-জীবন গঠনের প্রয়াসী ছিলেন, যা একটা দেশকে আগামীর পথে বহুদূর এগিয়ে দেবে, সনাতনের সন্ধানে পিছিয়ে দেবে না। এই জন্যই তিনি একটি কেন্দ্রের ভাবনা ভেবেছিলেন, যে কেন্দ্র থেকে ধর্মের নতুন তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে। সংস্কার তিনিও চাইছিলেন। কিন্তু সেই সংস্কার ঠিক বিধবা বিবাহ প্রচলনের মতো ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং তিনি একটা সাধারণ সূত্রে জাতির জাগরণ প্রত্যাশা করছিলেন। এবং সেখানে যে বড় ভূমিকা নেবে নিম্নবর্গের মানুষ, এ নিয়ে তাঁর মনে কোনও দ্বিধা ছিল না।
আরও শুনুন: নিজে ব্রহ্মের উপাসক, অথচ দেবী লক্ষ্মীকে নিয়ে গান লিখেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৮৯৪ সালে শিকাগো থেকে হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত চিঠিতে দুটি কথা তিনি খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন। একটি হল দেশের সর্বসাধারণের অবস্থার কথা, লিখেছিলেন- ‘ভারতবর্ষের ও আমেরিকার উচ্চবর্ণের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নাই সত্য, কিন্তু উভয়দেশের নিম্নবর্ণের মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। ভারতবর্ষ জয় করা ইংরেজের পক্ষে এত সহজ হইয়াছিল কেন? যেহেতু তাহারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ জাতি ছিল, আর আমরা তাহা ছিলাম না।’
আর তাই জাতির গঠনে এই সাধারণের জাগরণ তাঁর ভাবনায় খুব বড় গুরুত্ব পেয়েছিল। ওই চিঠিতেই তাই লিখেছিলেন, ‘সমস্ত ত্রুটির মূলই এইখানে যে, সত্যিকার জাতি- যাহারা কুটিরে বাস করে, তাহারা তাহাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলিয়া গিয়াছে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান- প্রত্যেকের পায়ের তলায় পিষ্ট হইতে হইতে তাহাদের মনে এখন এই ধারণা জন্মিয়াছে যে, ধনীর পদতলে নিষ্পেষিত হইবার জন্যই তাহাদের জন্ম। তাহাদের লুপ্ত ব্যক্তিত্ব-বোধ আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে। তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে হইবে। মূর্তিপূজা থাকিবে কি থাকিবে না, কতজন বিধবার পুনর্বার বিবাহ হইবে, জাতিভেদ প্রথা ভাল কি মন্দ, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার আমার প্রয়োজন নাই! প্রত্যেককেই তাহার মুক্তির পথ করিয়া লইতে হইবে।’
সেই সময়ের সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সামান্য মতপার্থক্য ছিল বইকি! কেননা তাঁর বিশ্বাস এই কাঠামোয় বাঁধা ছিল যে, ‘একটি কাষ্ঠখণ্ডকে উহার আঁশের অনুকূলেই যেমন সহজে চিরিয়া ফেলা যায়, তেমনই হিন্দুধর্মের দ্বারাই প্রাচীন হিন্দুধর্মের সংস্কার করিতে হইবে, নব্য সংস্কার আন্দোলন দ্বারা নহে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারকগণকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দেশের সংস্কৃতিধারা নিজ জীবনে মিলিত করিতে হইবে।’
এই যে মতাদর্শ, এর মধ্যে কোথাও পিছনে তাকানোর অবকাশ নেই। ধর্মকে সঙ্গে নিয়েই জীবনের নতুন প্রবাহ সন্ধান করছিলেন তিনি। এবং সেই বেগবান সভ্যতা শুধু উচ্চবর্ণের কল্যাণেই যে প্রবাহিত হবে তা নয়, তিনি চাইছেন, নিষ্পেষিত নিম্নবর্ণ তাঁদের স্বরূপে জেগে উঠুক। ফিরে পাক মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্ব-বোধ। এই যে প্রসারিত সংস্কার ভাবনা তা কখনোই একটি মত বা গোঁড়ামির পক্ষ নিতে পারে না। বিবেকানন্দ তা কখনও নেনওনি। সন্দেহ নেই যে, এই চিন্তার বীজ তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবনাতেই ছিল। বৈষ্ণব আন্দোলনের যে জীবে দয়ার সংস্কার, তা থেকে আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন, জীবে প্রেমের মহামন্ত্র। এখন সেই জীবে প্রেমের স্বরূপ সমাজ ও জীবনের প্রেক্ষিতে কেমন হবে? বিবেকানন্দের ধর্মভাবনা ও সংস্কার-চিন্তা মূলত সেই খাতেই প্রবাহিত হয়েছে। তাঁর সাফ কথা, ‘কুসংস্কার মানুষের শত্রু বটে, কিন্তু ধর্মান্ধতা আরও খারাপ।’ ১৮৯৫ সালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে যে চিঠি দিয়েছিলেন, সেখানে একই কথা যেন আরও স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন, ‘আমি হিন্দু ধর্মের উপর কোনও পুস্তক এক্ষণে লিখিতেছি না। তবে আমার মনের ভাব লিপিবদ্ধ করিতেছি। Every religion is an expression, a language to express the same truth and we must speak to each in his own language.’
অর্থাৎ ধর্মের সংকীর্ণতা পেরিয়ে তিনি পৌঁছতে চাইছেন ‘তাঁর ধর্ম’-এর মতো ব্যাপ্ত প্রসারিত ধারণায়। গুরুভাইয়ের উদ্দেশে তাই তিনি বলছেন, ‘… সংকীর্ণ ভাবের দ্বারাই ভারতের অধঃপতন হয়েছে। তার বিনাশ না হলে কল্যাণ অসম্ভব। আমার যদি টাকা থাকিত, তোমাদের প্রত্যেককেই পৃথিবী পর্যটনে পাঠাতাম। কোণ থেকে না বেরুলে কোন বড় ভাব হৃদয়ে আসে না।’ এই বড় ভাব এবং সর্বজনীনতাই বিবেকানন্দের ধর্মভাবনার গন্তব্য।
হিন্দু ধর্ম নিয়েও যখন তিনি তাঁর ভাবনা প্রকাশ করছেন, তখনও পরিষ্কার করেই জানিয়ে দিচ্ছেন যে, ‘হিন্দুর সমগ্র ধর্মভাব অপরোক্ষানুভূতিতেই কেন্দ্রীভূত। ঈশ্বরকে উপলব্ধি করিয়া মানুষকে দেবতা হইতে হইবে। মন্দির, প্রার্থনাগৃহ, দেববিগ্রহ বা ধর্মশাস্ত্র- সবই মানুষের ধর্মজীবনের প্রাথমিক অবলম্বন এবং সহায়ক মাত্র, তাহাকে ক্রমশ অগ্রসর হইতে হইবে।’
অতএব, হিন্দু ধর্মের সূত্র ধরেই বিবেকানন্দ ক্রমশ উপনীত হচ্ছেন এক ‘সর্বজনীন ধর্ম’-এ। বলছেন, ‘সেই ধর্মের নীতিতে কাহারও প্রতি বিদ্বেষ বা উৎপীড়নের স্থান থাকিবে না; উহাতে প্রত্যেক নরনারীর দেবস্বভাব স্বীকৃত হইবে এবং উহার সমগ্র শক্তি মনুষ্য-জাতিকে দেব-স্বভাব উপলব্ধি করিতে সহায়তা করিবার জন্যই স্বতঃ নিযুক্ত থাকিবে।’ এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে গেলে ধর্ম আসলে হয়ে ওঠে সেই ‘নূতন অন্তরিন্দ্রিয়’-ই।
আজ যখন ধর্মভাবনাকে আমরা ধর্মস্থান, আচার-বিচার-সংস্কারেই আটকে ফেলছি ক্রমাগত, তখন আসলে খাটো করে ফেলছি স্বামীজির ভাবনাকেও। বলা যায়, সরে যাচ্ছি সেই ধর্মের সর্বজনীনতা থেকে। পিছনের দিকে তাকাতে তাকাতে ভুলে যাচ্ছি যে, বিবেকানন্দের ধর্ম আমাদের সামনে এগিয়ে দিতেই শিখিয়েছিল।