ঠাকুরের অন্যতম ভক্ত ছিলেন মণিলাল মল্লিকের কন্যা। একবার তিনি জানালেন, যখনই তিনি ধ্যান করতে বসছেন, তখনই তাঁর মন অন্য কিছুতে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত হচ্ছে তাঁর ধ্যান। এই অসুবিধার কথা ঠাকুরকে তিনি জানালেন।
সাধনার ধারায় বদল আনছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। আমরা এর আগে শুনেছি কীভাবে তিনি ‘জীবে প্রেম’ এই কথাটির অর্থই বদলে দিয়েছিলেন। তাঁর আগে বুদ্ধ বা চৈতন্যও এই প্রেমের বাণী প্রচার করেছিলেন। কিন্তু ঠাকুর এই প্রেমকে অধ্যাত্মসাধনার পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসাবে না দেখে, এটিকেই পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে চাইছিলেন। এবং সেই কথাই নানা ঘটনার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁর ভক্তদের। শম্ভুচন্দ্র মল্লিককে যেমন বোঝালেন যে দানধ্যান করা বা সমাজসেবা করার মধ্যে কোনও দোষ নেই। তা নিঃসন্দেহে ভাল কাজ। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, এটি একটি উপায় মাত্র। মানুষের জীবনের আসল উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে লাভ। তা থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩২): ভক্তের ইচ্ছা সমাজসেবা করার, ঠাকুর তাঁকে কী বললেন?
এইভাবে ঈশ্বর উপাসনার নতুন একটা দিক দেখিয়ে দিচ্ছিলেন ঠাকুর। কিন্তু এখানেও একটা বিশেষত্ব আছে। একটাই নিয়ম যে সবাইকে কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে, এমন জোরাজুরি তিনি করেন না। ঈশ্বর লাভই একমাত্র উদ্দেশ্য। সুতরাং যিনি যেভাবে পারেন সেই পথটা যেন খুঁজে পান, এইটাই ঠাকুরের একমাত্র চাওয়া। এই সিদ্ধান্তও রীতিমতো আধুনিক। ঠাকুর তাই ব্যক্তিবিশেষে সাধনার পৃথক উপায় বাতলে দিচ্ছিলেন। অথচ সব পথেরই গন্তব্য এক। এই যে তিনি মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে দেখতে বলছিলেন এর একটা স্পষ্ট উদাহরণ হিসাবে আমরা একটা ঘটনার কথা জানতে পারি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩১): গুরুর বাণীর রহস্য জগৎবাসীকে শোনানোর প্রতিজ্ঞা নরেন্দ্রনাথের
ঠাকুরের অন্যতম ভক্ত ছিলেন মণিলাল মল্লিকের কন্যা। একবার তিনি জানালেন, যখনই তিনি ধ্যান করতে বসছেন, তখনই তাঁর মন অন্য কিছুতে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত হচ্ছে তাঁর ধ্যান। এই অসুবিধার কথা ঠাকুরকে তিনি জানালেন। অন্য সাধক পুরুষ হলে হয়তো ধ্যানের নিয়মকানুনের উপর জোর দিতে বলতেন। কিন্তু ঠাকুরের পদ্ধতি একেবারে আলাদা। ঠাকুর জানতে চাইলেন, ধ্যানের সময় তাঁর মনে কার মুখ ভেসে ওঠে? বা কীসের দিকে মন চলে যায়? শিষ্যা জানালেন, তাঁর এক ভাইপো আছে। যখনই তিনি ধ্যানে বসেন তখন ওই নিষ্পাপ শিশুর মুখটিই তাঁর মনের প্রদায় ভেসে ওঠে। এ কথা শুনে ঠাকুর ভক্তকে তাঁর মতো করে একটি পথ বলে দিলেন। বললেন, ধ্যানের সময় মেয়েটি যেন ওই শিশুটির মুখটিকেই যেন তিনি দেখেন। তবে শুধুমাত্র ভাইপো হিসাবে না দেখে, যেন শিশুটিকেই তিনি বালক কৃষ্ণ হিসাবে দেখেন। ঠাকুর স্পষ্ট তাঁকে উপদেশ দিলেন, ভাইপোকেই গভীরভাবে ভালোবাসতে। কেননা ঠাকুর জানতেন, এই ভালোবাসাই ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগে রূপান্তরিত হবে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৯): মানুষ বড় কাঁদছে, মথুরবাবুকে বলে তাঁদের অন্নের ব্যবস্থা করলেন ঠাকুর
এই ঘটনাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষকেই ঈশ্বর হিসাবে দেখার কথা বলছিলেন ঠাকুর। স্বতন্ত্র সাধনার ধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন সকলের। তারই একটা নমুনা তাঁর এই উপদেশ। মানুষের জীবনে যে প্রিয়পাত্র তাকে ভালবেসেই সেই ভালবাসাকে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসায় পরিণত করা যায়। অর্থাৎ এভাবেও আধ্যাত্মিক সাধনা যে সম্ভব, সেটাই বুঝিয়ে দিলেন ঠাকুর। তাঁর উপদেশ মেনে এই শিষ্যাও সাধনপথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এখন, জীবে প্রেম করার কথা আগেও অনেকে বলেছেন। কিন্তু এই যে নিজের প্রিয়পাত্রের সঙ্গে ঈশ্বরকে অবিচ্ছেদ্য ভাবে মিলিয়ে দেখা, এ যেন একেবারে নতুন একটা অধ্যায়। এবং এর ফলে অন্যকে ভালবাসার ভিতরও একরকম আধ্যাত্মিক তাৎপর্য থেকে যায়। তখন আর কেবল সমাজসেবা বা দানের জন্য দান ইত্যাদি বিষগুলি অগ্রাধিকার পায় না। মানুষের সেবা আর ঈশ্বরের পূজা এক হয়ে যায়। আবার আত্মীয়ের প্রতি যে ভালবাসা তার থেকেও এই ভালবাসা আলাদা হয়ে যায়। এইভাবেই ঠাকুর এক স্বতন্ত্র সাধনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন জগৎবাসীকে। এই ধারাটি চিনতে পারলেই এমরা তাঁর পরম শিষ্য নরেন্দ্রনাথের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের মূলসূরটিকে চিনতে পারব।