গ্রামের রমণীরা চলেছেন বিশালাক্ষি দেবীর পূজা দিতে। বালক গদাধরও চলেছেন তাঁদের সঙ্গে। দেবীর নাম গাইছেন। গাইতে গাইতে হঠাৎ বালকের বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে গেল। মহিলারা ধরাধরি করে তাকে শুইয়ে দিলেন একটা জায়গায়। চোখেমুখে দিলেন জলের ঝাপটা। কিন্তু কিছুতেই আর তার ঘোর কাটে না। শেষে রমণীরা বালকের কানের কাছে মুখ এনে বিশালাক্ষি দেবীর নাম গাইতে লাগলেন। দেবীর নাম শুনে ক্রমে ক্রমে চেতনা ফিরে পেয়েছিলেন ঠাকুর।
ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা বলতে গিয়েই শ্রীরামকৃষ্ণের কথা বলেছিলেন প্রিন্সিপাল হেসটি সাহেব। তাঁর মুখেই ঠাকুরের নাম প্রথম শুনেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। একজন কবির কথা বলতে গিয়েই সেদিন ঠাকুরের কথা উঠেছিল। দুজনেরই যেরকম ভাবসমাধি হয়, সেই তুলনা করতে গিয়েই হেসটি সাহেব এ কথা বলেছিলেন। তবে ঠাকুরের জীবনে সত্যিই এমন ঘটনা ঘটেছিল, যা একজন কবির ক্ষেত্রেই বুঝি সত্যি হয়ে উঠতে পারে। হেসটি সাহেবের সে ঘটনার কথা জানার কথা নয়। তবে তুলনাটি তিনি যে যথার্থই করেছিলেন তা আর উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৬): ঠাকুর চোরকে বলেন চুরি করতে, গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে!
ঠাকুরের তখন কতই বা বয়স! নেহাতই বালক তিনি তখন। মুড়ি খেতে খেতে ধানখেতের আলপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আকাশ নুয়ে পড়েছে কালো মেঘে। আর সেই মেঘমালার ভিতর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল একঝাঁক শ্বেতশুভ্র বক। কালো-সাদার বৈপরীত্যে প্রকৃতিতে তখন এক অপরূপ শোভা। সেই সৌন্দর্য দেখে হঠাৎ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল বালক গদাধর। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তখন অন্যেরা ধরাধরি করে বালককে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে এই যে অতীন্দ্রিয় অনুভূতিলাভ, এ তো একজন কবির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তা হয়েছিল ঠাকুরের বাল্যজীবনেই। কেন যে এই ঘটনা ঘটেছিল, ব্যাখ্যা যুক্তিতে তার হদিশ মেলে না। আর একটি আশ্চর্য বিষয় খেয়াল করুন। উত্তরকালে এক কবির কলমেই তো উঠে আসবে এমন দুটি পঙক্তি – আকাশে উড়িছে বকপাঁতি/ বেদনা আমার তারই সাথি। যে সৌন্দর্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আবিষ্ট করেছিল, সেই একই সৌন্দর্য একদিন আচ্ছন্ন করেছিল বালক গদাধরকেও। ঠাকুর তো কবি নন। কিন্তু এই ঘটনা থেকে আমরা তাঁর কল্পনাশক্তির প্রসার, তাঁর মনটিকে বুঝতে পারি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৫): উপনয়নের সময়ই সংস্কারের বেড়া ভেঙেছিলেন বালক গদাধর
পরবর্তীতে বারবার বালক গদাধরের সঙ্গে এরকম ঘটনা ঘটতে থাকল। একবার পাড়ার যাত্রাপালায় তাকে শিব সাজানো হয়েছে। গান-বাজনা ছোট থেকেই ভালবাসতেন তিনি। রামায়ণের অংশ আবৃত্তি করতেন। আবার পুরাণের গল্পের কিছু কিছু অভিনয়ও করতেন। সেদিন পালার সময় বালক গদাধরকে মহাদেবের বেশে সাজিয়ে দেওয়া হল। মাথায় জটাজূট, অঙ্গে বিভূতি, হাতে ত্রিশূল। এই সাজে বালকের মন আচ্ছন্ন হল দেবাদিদেবের চিন্তায়। তার দুচোখ দিয়ে কেবল জল গড়িয়ে পড়ে। দেহ যেন নিস্পন্দ। আত্মসমাহিত হয়ে পড়ল সে বালক। একদিনে সেই দশা কাটল না। দিন তিনেক পরে ক্রমে যেন প্রকৃতিস্থ হলেন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৪): অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বুঝলেন নরেন্দ্রনাথ
আর একবার গ্রামের রমণীরা চলেছেন বিশালাক্ষি দেবীর পূজা দিতে। বালক গদাধরও চলেছেন তাঁদের সঙ্গে। দেবীর নাম গাইছেন। গাইতে গাইতে হঠাৎ বালকের বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে গেল। মহিলারা ধরাধরি করে তাকে শুইয়ে দিলেন একটা জায়গায়। চোখেমুখে দিলেন জলের ঝাপটা। কিন্তু কিছুতেই আর তার ঘোর কাটে না। শেষে রমণীরা বালকের কানের কাছে মুখ এনে বিশালাক্ষি দেবীর নাম গাইতে লাগলেন। দেবীর নাম শুনে ক্রমে ক্রমে চেতনা ফিরে পেয়েছিলেন ঠাকুর।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৩): ঠাকুরের স্পর্শে আচ্ছন্ন নরেন্দ্রনাথ… মা ভাবলেন, ছেলে বুঝি বাঁচবে না!
তাঁর এরকম সমাধির ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বিগ্ন ছিলেন বাড়ির বড়রা। কিন্তু ঠাকুর নিজে এ বিষয়ে তেমন চিন্তিত ছিলেন না। আচ্ছন্ন ভাব কেটে গেলেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেন। তবে সেই বয়সেই তিনি বুঝতে পারতেন, এমন কিছু একটা তাঁর সঙ্গে ঘটে যা আর পাঁচজন বালকের সঙ্গে হয় না। আর ওই সমাধির সময় এক অপার্থিব আনন্দে তাঁর মন পূর্ণ হয়ে যায়। যেন দেবত্বের সংস্পর্শ লাভ করেন তিনি। কিন্তু এই উপলব্ধি তাঁর আচরণে কোথাও প্রকাশ পায়নি। অন্যান্য সময় আর পাঁচটি বালক যেমন কাটাত, তেমন স্বাভাবিক ভাবেই কাটত বালক গদাধরের জীবন। পরবর্তীকালেও তিনি এই ভাবখানা বজায় রেখেছিলেন। নিজের গুণ, শক্তি সকলই লুকিয়েছিলেন। সহজে তা প্রকাশ করতেন না। একমাত্র ব্যতিক্রম নরেন্দ্রনাথ। তাঁর কাছে ঠাকুরের কখনোই কোনও রাখঢাক ছিল না।