যিনি যত ধার্মিক মানুষই হোন না কেন, সংসারে থাকতে গেলে পাঁচজনের সঙ্গে তাল মিলিয়েই থাকতে হয়। কেউ সদুপদেশ দেন। কেউবা আবার অনিষ্ট করতে চান। কে তাই কীরকম মানুষ, তা চিনে নেওয়া জরুরি। একবার ভক্তদের এই উপদেশ দিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। আসুন আমরা আজ সেই কথা শুনে নিই।
বিজয় গোস্বামী তখনও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত, ওই ব্রাহ্মসমাজে একজন বেতনভোগী আচার্য। তবে তিনি ব্রাহ্মসমাজের সব নিয়ম যেন মেনে চলতে পারছিলেন না। সাকারবাদীদের সঙ্গেও মেলামেশা করছিলেন। এই সব নিয়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের কর্তৃপক্ষর সঙ্গে তাঁর মনান্তর হচ্ছে। সমাজের ব্রাহ্মভক্তদের অনেকেই তাঁর উপর অসন্তুষ্ট। ঠিক এই সময় একদিন ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর দেখা।
আরও শুনুন: বাইরে নয়, প্রকৃত বন্ধু কিংবা শত্রুর বাস আমাদের ভিতরেই
ঠাকুর তাঁকে দেখে হেসে বললেন— তুমি সাকারবাদীদের সঙ্গে মেশো বলে তোমার নাকি বড় নিন্দা হয়েছে? যে ভগবানের ভক্ত তার কূটস্থ বুদ্ধি হওয়া চাই। যেমন কামারশালের নাই। হাতুড়ির ঘা অনবরত পড়ছে, তবু নির্বিকার। অসৎ লোকে তোমাকে কত কী বলবে, নিন্দা করবে! তুমি যদি আন্তরিক ভগবানকে চাও, তুমি সব সহ্য করবে। দুষ্টলোকের মধ্যে থেকে কি আর ঈশ্বরচিন্তা হয় না? দেখ না, ঋষিরা বনের মধ্যে ঈশ্বরকে চিন্তা করতো। চারিদিকে বাঘ, ভাল্লুক, নানা হিংস্র জন্তু। অসৎ লোকের, বাঘ ভাল্লুকের স্বভাব; তেড়ে এসে অনিষ্ট করবে।” এই পর্যন্ত বলে ঠাকুর একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন। এবার তিনি যে কথাগুলি বলছেন, তা যেন শুধু বিজয় গোস্বামীকে উদ্দেশ্য করে নয়। বরং সমস্ত ভক্ত, সমস্ত মানুষকেই তিনি কিছু গূঢ় জিনিস শিখিয়ে দিতে চাইছেন। ঠাকুর বলছেন, “এই কয়েকটির কাছ থেকে সাবধান হতে হয়! প্রথম, বড়মানুষ। টাকা লোকজন অনেক, মনে করলে তোমার অনিষ্ট করতে পারে; তাদের কাছে সাবধানে কথা কইতে হয়। হয়তো যা বলে, সায় দিয়ে যেতে হয়!”
আরও শুনুন: ‘জগৎ তোমার’ – এই মহামন্ত্রে ভক্তদের প্রাণিত করেছিলেন মা সারদা
“তারপর কুকুর। যখন কুকুর তেড়ে আসে কি ঘেউ ঘেউ করে, তখন দাঁড়িয়ে মুখের আওয়াজ করে তাকে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর ষাঁড়। গুঁতুতে এলে, তাকেও মুখের আওয়াজ করে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর মাতাল। যদি রাগিয়ে দাও, তাহলে বলবে, তোর চৌদ্দপুরুষ, তোর হেন তেন, — বলে গালাগালি দিবে। তাকে বলতে হয়, কি খুড়ো কেমন আছ? তাহলে খুব খুশি হয়ে তোমার কাছে বসে তামাক খাবে। অসৎ লোক দেখলে আমি সাবধান হয়ে যাই। যদি কেউ এসে বলে, ওহে হুঁকোটুকো আছে? আমি বলি আছে। কেউ কেউ সাপের স্বভাব। তুমি জান না, তোমায় ছোবল দেবে। ছোবল সামলাতে অনেক বিচার আনতে হয়। তা না হলে হয়তো তোমার এমন রাগ হয়ে গেল যে, তার আবার উলটে অনিষ্ট করতে ইচ্ছা হয়। তবে মাঝে মাঝে সৎসঙ্গ বড় দরকার। সৎসঙ্গ কল্লে তবে সদসৎ বিচার আসে।”
ঠাকুরের কথা সব মন দিয়ে শুনলেন বিজয় গোস্বামী। তারপর বললেন, অবসর নাই, এখানে কাজে আবদ্ধ থাকি। ঠাকুর তাঁকে বললেন, তোমরা আচার্য; অন্যের ছুটি হয়, কিন্তু আচার্যের ছুটি নাই। নায়েব একধার শাসিত কল্লে পর, জমিদার আর-একধার শাসন করতে তাকে পাঠান। তাই তোমার ছুটি নাই।
আরও শুনুন: গুরুবাক্যে চাই অটল বিশ্বাস, সেরকম বিশ্বাসের খোঁজ মেলে ব্যাসদেবের গল্পে
ঠাকুরের এই কথা শুনে সকলেই হেসে উঠলেন। বিজয় গোস্বামী কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন — আপনি একটু আশীর্বাদ করুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বললেন, — ও-সব অজ্ঞানের কথা। আশীর্বাদ ঈশ্বর করবেন।
শুনে নিন বাকি অংশ।