ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলে ঈশ্বরলাভের পথে এগোনো যায় না। সে পথে এগোতে চাই গুরুর সন্ধান। আর গুরু যে পথ বাতলে দেবেন, সেই পথে থাকা চাই বিশ্বাস। গুরুবাক্যে বিশ্বাস ছাড়া সাধনার পথে এগোনো যায় না। কিন্তু কেমন সে বিশ্বাসের জোর? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একবার তা বুঝিয়েছিলেন গল্পে গল্পে। আসুন শুনে নিই।
ভক্তদের উদ্দেশে ঠাকুর বলেন, সাধন বড় দরকার। তবে হবে না কেন? ঠিক বিশ্বাস যদি হয়, তাহলে আর বেশি খাটতে হয় না। গুরুবাক্যে বিশ্বাস! কীতকম এই বিশ্বাস? বিশ্বাসের জোর কতটা হতে পারে? তা বোঝাতে ঠাকুর একখানা গল্প বলা শুরু করলেন –
“ব্যাসদেব যমুনা পার হবেন, গোপীরা এসে উপস্থিত। গোপীরাও পার হবে কিন্তু খেয়া মিলছে না। গোপীরা বললে, ঠাকুর! এখন কি হবে? ব্যাসদেব বললেন, আচ্ছা তোদের পার করে দিচ্ছি, কিন্তু আমার বড় খিদে পেয়েছে, কিছু আছে? গোপীদের কাছে দুধ, ক্ষীর, নবনী অনেক ছিল, সমস্ত ভক্ষণ করলেন। গোপীরা বললে, ঠাকুর পারের কি হল। ব্যাসদেব তখন তীরে গিয়ে দাঁড়ালেন; বললেন, হে যমুনে, যদি আজ কিছু খেয়ে না থাকি, তোমার জল দুভাগ হয়ে যাবে, আর আমরা সব সেই পথ দিয়ে পার হয়ে যাব। বলতে বলতে জল দুধারে সরে গেল। গোপীরা অবাক্; ভাবতে লাগল — উনি এইমাত্র এত খেলেন, আবার বলছেন, ‘যদি আমি কিছু খেয়ে না থাকি?’ ঠাকুর বলছেন, “এই দৃঢ় বিশ্বাস। আমি না, হৃদয় মধ্যে নারায়ণ — তিনি খেয়েছেন।”
আরও শুনুন: ঈশ্বরকে মানুষ আর মানুষকে ঈশ্বরের মতো করে দেখার শিক্ষা শ্রীরামকৃষ্ণের
এই বিশ্বাসের কাছে পৌঁছাতে বহু জ্ঞানীজনকেও কষ্ট করতে হয়। সে কথা বোঝাতে ঠাকুর শঙ্করাচার্যের উদাহরণ দিলেন। বললেন, “শঙ্করাচার্য এদিকে ব্রহ্মজ্ঞানী; আবার প্রথম প্রথম ভেদবুদ্ধিও ছিল। তেমন বিশ্বাস ছিল না। চণ্ডাল মাংসের ভার লয়ে আসছে, উনি গঙ্গাস্নান করে উঠেছেন। চণ্ডালের গায়ে গা লেগে গেছে। বলে উঠলেন, ‘এই তুই আমায় ছুঁলি!’ চণ্ডাল বললে, ‘ঠাকুর, তুমিও আমায় ছোঁও নাই, আমিও তোমায় ছুঁই নাই।’ যিনি শুদ্ধ আত্মা, তিনি শরীর নন, পঞ্চভূত নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন। তখন শঙ্করের জ্ঞান হয়ে গেল।
আরও শুনুন: দুষ্ট লোক অনিষ্ট করতে চাইলে ধার্মিক মানুষের কী করণীয়?
আবার যদি জড়ভরতের কথা যদি ধরা যায় সেখানেও একই জ্ঞান মেলে। ঠাকুর বলছেন, “জড়ভরত রাজা রহুগণের পালকি বহিতে বহিতে যখন আত্মজ্ঞানের কথা বলতে লাগল, রাজা পালকি থেকে নিচে এসে বললে, তুমি কে গো! জড়ভরত বললেন, আমি নেতি, নেতি, শুদ্ধ আত্মা। একেবারে ঠিক বিশ্বাস, আমি শুদ্ধ আত্মা।” অর্থাৎ ঠাকুর আমাদের বলতে চান, “ ‘আমিই সেই’ ‘আমি শুদ্ধ আত্মা’ — এটি জ্ঞানীদের মত। ভক্তেরা বলে, এ-সব ভগবানের ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্য না থাকলে ধনীকে কে জানতে পারত? তবে সাধকের ভক্তি দেখে তিনি যখন বলবেন, ‘আমিও যা, তুইও তা’ তখন এক কথা। রাজা বসে আছেন, খানসামা যদি রাজার আসনে গিয়ে বসে, আর বলে, ‘রাজা তুমিও যা, আমিও তা’ লোকে পাগল বলবে। তবে খানসামার সেবাতে সন্তুষ্ট হয়ে রাজা একদিন বলেন, ‘ওরে, তুই আমার কাছে বোস, ওতে দোষ নাই; তুইও যা, আমিও তা!’ তখন যদি সে গিয়ে বসে, তাতে দোষ হয় না। সামান্য জীবেরা যদি বলে, ‘আমি সেই’ সেটা ভাল না।
ঠাকুর তাই আমাদের সারকথাটি ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘জলেরই তরঙ্গ; তরঙ্গের কি জল হয়?’