ব্রাহ্মণরা বলে থাকেন যে রামকৃষ্ণের নাকি খুব অহঙ্কার! ঠাকুর মৃদু হেসে জবাব দিলেন, ও কথায় কান দিয়ো না। তাদের তো জানো, না দিলেই খারাপ লোক, দিলেই ভাল। শুনে সকলেই হাসিতে ফেটে পড়লেন। কিন্তু এই সাধারণ একটা কথাতেই সেকালের সমাজ, অর্থনীতির দিকটি খোলসা হয়ে পড়ে। পুরোহিতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতি ও সেই সূত্রে শ্রেণির প্রশ্ন যে কীভাবে জড়িয়ে ছিল তা এই একটা কথাতেই বোঝা যায়। ঠাকুর যত সরল সাধাসিধেই ভাবে থাকুন না কেন, এই বাস্তবতা বেশ বুঝতেন।
গুরু শ্রী রামকৃষ্ণ সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন, ‘তিনি যে-ধর্মের লোকেদের বুঝতে চাইতেন তাঁদের মতো আহার্য গ্রহণ করতেন এবং তাঁদের ভাষা ব্যবহার করতেন’। এ বিষয়ে ঠাকুরের বিশ্বাস ছিল এই যে, ‘অপরের মনের ভিতর প্রবেশ করা শিখতে হবে’। স্বামীজি জানাচ্ছেন, এ পথ ছিল তাঁর নিজস্ব। এই নিজস্ব পথ ধরে এগোতে গিয়ে ঠাকুর কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা সেকালের নিরিখে একেবারেই ব্যতিক্রমী। ঠাকুর ধর্মকে কোনও নির্দিষ্ট খোপে আটকে রাখতে চাইছিলেন না। তাই মতের দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে তিনি সরল পথের দিকে এগোচ্ছিলেন। জগৎকে বলার চেষ্টা করছেন, প্রত্যেক মতের পথ ধরেই একই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায়। ফলে সকল ভক্তের কাছে তার তার ধর্ম ভাল। এ নিয়ে অনর্থক জেদাজেদি করে কাজ নেই। এখন এই যে সমন্বয়ের পথ তা কতটা সমন্বয় সাধন করতে পেরেছিল, সে তো আলাদা কথা। কিন্তু ঠাকুর যে সময়কার মানুষ, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, ধর্মের এমন প্রকাশ, বলা যায় ধর্মকে এমন বিশ্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা আর কেউই করেননি। ভাবেননি পর্যন্ত এ বিষয়ে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৯): মানুষ বড় কাঁদছে, মথুরবাবুকে বলে তাঁদের অন্নের ব্যবস্থা করলেন ঠাকুর
এইখানেই ঠাকুর আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। আর তাই দেখা যাচ্ছে, সেকালের সাধুদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর মিল পাওয়া যাচ্ছে না। সাধুরা সিদ্ধাই প্রকাশ করেন, তিনি সিদ্ধ পুরুষ হয়েও নিজেকে গোপন করে রাখেন। সেকালের পুরোহিততন্ত্রেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ব্রাহ্মণরা বলে থাকেন যে রামকৃষ্ণের নাকি খুব অহঙ্কার! ঠাকুর মৃদু হেসে জবাব দিলেন, ও কথায় কান দিয়ো না। তাদের তো জানো, না দিলেই খারাপ লোক, দিলেই ভাল। শুনে সকলেই হাসিতে ফেটে পড়লেন। কিন্তু এই সাধারণ একটা কথাতেই সেকালের সমাজ, অর্থনীতির দিকটি খোলসা হয়ে পড়ে। পুরোহিতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতি ও সেই সূত্রে শ্রেণির প্রশ্ন যে কীভাবে জড়িয়ে ছিল তা এই একটা কথাতেই বোঝা যায়। ঠাকুর যত সরল সাধাসিধেই ভাবে থাকুন না কেন, এই বাস্তবতা বেশ বুঝতেন। এবং তার প্রতিকারও চাইতেন। কিন্তু কী উপায়ে তা সম্ভব! ঠিক ধর্ম বোঝার ক্ষেত্রে যেমন ছিল তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি, এক্ষেত্রেও তিনি নিজের মতো করেই পথ অবলম্বন করলেন। ধর্মের যে বিশ্বজনীন রূপ তাঁর ভাবনায় সেখান থেকে তিনি স্পষ্টই বুঝলেন ধর্ম যদি আর্ত মানুষকে উঠে দাঁড় করাতে না পারে, তবে তার সার্থকতা ক্রমশ তত্ত্ব আর মতের জঙ্গলে হারিয়ে যাবে। সেই হেতুই তিনি বেশ কিছু কাজ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্যদের প্রধান কজা হয়ে উঠবে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৮): মাতৃতর্পণের সময় ঠাকুরের সঙ্গে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা
আমরা আগেই শুনেছি যে, অনাহারক্লিষ্ট মানুষের খাজনা মকুবের জন্য তিনি রাজি করিয়েছলেন মথুরবাবুকে। আজ আর একটা ঘটনার কথা শুনব। সেবার ঠাকুর বেরিয়েছেন তীর্থভ্রমণে। চলেছেন দেওঘরের বৈদ্যনাথধামে। এখন তিনি সাধু মানুষ, দেবতার দর্শন করলেই তাঁর মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেওঘরের পথ ধরে যত তিনি এগোচ্ছেন, দেখছেন মানুষের কী দুর্দশা! সে সময় ওই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ চলছিল। অস্থিচর্মসার মানুষ রাস্তার দুপাশে। তাদের কারও কারও পরনের কাপড়টুকুও নেই। এই দৃশ্য দেখে ঠাকুর আর স্থির থাকতে পারলেন না। সেই মানুষগুলোর পাশে বসে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। এমনকী ঠিক করলেন, তিনিও অনশনে প্রাণত্যাগ করবেন। সেবারও পাশে ছিলেন সেই মথুরবাবু। তিনি পড়লেন মহা বিপদে। কিন্তু ঠাকুরকে ওই অবস্থায় দেখে তিনিও আর স্থির থাকতে পারলেন না। বহু অর্থব্যয় করে সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের মধ্যে খাবার এবং পোশাক বিতরণের ব্যবস্থা করলেন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৭): দিব্য দাম্পত্যে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ দূর করলেন ঠাকুর
ঠাকুরের এই যে ব্যবহার, নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে এই যে তাদের দুঃখে সমব্যথী হয়ে ওঠা, এ তো সে আমলের পুরোহিততন্ত্রের ঠিক উলটো। ঠাকুরের পদ্ধতি ছিল নিজস্ব। আর পাঁচজনের নয়। কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ঠাকুর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ধর্মের সার্থকতা ঠিক কোথায়। তিনি যেমন মা কালীর মূর্তিকেও নিষ্প্রাণ মনে করতেন না, তেমনই এই যে বিরাট জনসমাজের প্রাণস্পন্দনও তাঁকে স্পর্শ করত। ঠাকুরের এই বৈপ্লবিক ভাবনার ফল ফলেছিল উত্তরকালে, তাঁর শিষ্য নরেন্দ্রনাথের হাত ধরেই।