ধর্মের নামে যে অনুশাসন সাধারণ মানুষকে শোষণ করে চলেছিল, গাঢ় অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘যে দেশে লক্ষ লক্ষ লোক মহুয়া ফুলের রস খেয়ে জীবন ধারণ করে সেখানে এ কি ধর্ম, না শয়তানের তাণ্ডব নৃত্য!” দেশ ও সমাজের আমূল বদল চেয়েছিলেন স্বামীজি।
নরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠলেন, তখন খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘তোমাকে যেতে হবে ভারতের নিমজ্জমান লক্ষ লক্ষ জনগণের কাছে, এবং তাদের তুলতে হবে হাত ধরে।” সেই সময় ধর্মের নামে যে অনুশাসন সাধারণ মানুষকে শোষণ করে চলেছিল, গাঢ় অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘যে দেশে লক্ষ লক্ষ লোক মহুয়া ফুলের রস খেয়ে জীবন ধারণ করে সেখানে এ কি ধর্ম, না শয়তানের তাণ্ডব নৃত্য!” দেশ ও সমাজের আমূল বদল চেয়েছিলেন স্বামীজি। সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নতি ব্যতীত তা হওয়া সম্ভব নয়, এই ছিল তাঁর স্পষ্ট মত। ধর্ম যেন সে পথে বাধা না হয়, এই সত্য বারবার তিনি সকলকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের কষ্ট নিবারণ না হলে কি জাতি উন্নত হতে পারে! সেই কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছে বলেই স্বামিজী একদা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “বড়ই দুঃখের বিষয় এদেশের দরিদ্রদের কথা কেউ চিন্তা করে না। তারাই জাতির মেরুদন্ড, তাদের শ্রমেই খাদ্য উৎপন্ন হয়। কিন্তু তাদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর কেউ নেই, তাদের দুঃখে সান্ত্বনা দেবার লোকও নেই।”
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৮): মাতৃতর্পণের সময় ঠাকুরের সঙ্গে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা
স্বামীজির এই যে ওজস্বী বক্তব্য, দেশ গঠনে চিন্তাধারা এর একটা পূর্বছায়া আমরা পেয়ে যাই তাঁর গুরুর জীবনেও। সমস্ত সাধনপথ ঘুরেই ধর্মের এক অন্য তাৎপর্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঠাকুর। একদিকে তিনি বলছেন, যত মত তত পথ। যা সব ধর্ম ও মতের সহাবস্থানকে চিহ্নিত করে। অন্যদিকে শোনাচ্ছেন সেই যুগান্তকারী কথা, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। এ কথাও তো অনুশাসনের নিগড় ভেঙে ধর্মকে মানুষের কাছে যেতে বলে। যে কাজ করেছেন তাঁর শিষ্য বিবেকানন্দ। তবে ঠাকুর নিজের জীবনেই যেন সে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৭): দিব্য দাম্পত্যে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ দূর করলেন ঠাকুর
অন্যের কষ্ট দেখতে পারতেন না ঠাকুর। কারোর উপর যদি শারীরিক অত্যাচার করা হত, ঠাকুর তা দেখলে, নিজেও একই রকম শারীরিক কষ্ট অনুভব করতেন। এ আসলে আমাদের শাস্ত্রের গভীর বাণী। অন্যের দুঃখ যদি প্রাণে না বাজে, তবে সেই দুঃখ মোচন করা যায় না। ঠাকুরের ক্ষেত্রে তা সত্যি আক্ষরিক ভাবে। একবার নৌকায় একজন লোক মাঝিকে প্রহার করছিল। বেচারার পিঠে মারের চোটে কালসিটে পড়ে গেল। ঠাকুর তা দেখে কেঁদে উঠে বললেন, ওগো তোমরা আমাকেই বরং মেরে ফেল। পরে দেখা গেল, ঠাকুরে পিঠেও কালসিটে পড়ে গেছে। ঠাকুর তাঁর মতো করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, আর্ত পীড়িতের সমব্যথী না হলে, তাদের পাশে না দাঁড়ালে ধর্মরক্ষা হয় না।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৬): সংসার আর সন্ন্যাসকে আশ্চর্য সমন্বয়ে বেঁধেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
ঠাকুরের এই ভাবনা যিনি মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন, তিনি হলেন মথুরবাবু। তিনি বৈষয়িক মানুষ। আবার ঠাকুরকেও খুব ভালবাসতেন। একদিন করলেন কী, ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়েই চললেন এক তালুকের খাজনা আদায় করতে। সেই তালুকের মানুষেরা তখন বেশ দুঃখেই ছিলেন। পরপর দুবছর ভালো ফসল হয়নি। এমনিই খাবার দাবার নেই। আধপেটা খেয়ে কি অনশনে-উপবাসে দিন কাটে। তার উপর স্বয়ং জমিদার এসেছেন খাজনা আদায় করতে। ভয়ে-চিন্তায় তাঁরা অস্থির। ঠাকুর তাঁদের চোখের জল দেখলেন। তাঁদের কষ্ট অনুভব করলেন প্রাণে। সঙ্গে সঙ্গে মথুরবাবুকে বললেন, এবারটা যেন এই দুঃখী মানুষগুলোর থেকে খাজনা আদায় না-করা হয়। মথুরবাবু জমিদার ঠিকই, কিন্তু ঠাকুরের আদেশ তিনি ফেলেন কী করে! পড়লেন আতান্তরের! এদিকে ঠাকুরের আদেশ হল, খাজনা তো ছার, এই অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলোকে যেন খাওয়ানোরও ব্যবস্থা করা হয়, আর তাদের কিছু কিছু অর্থসাহায্য করা হয়। মথুরবাবুর অবস্থাটা একবার ভাবুন! ঠাকুর নিজেও বুঝলেন সে কথা। তখন তিনি মথুরবাবুকে বুঝিয়ে বললেন, সম্পত্তির মালিক তো মথুরবাবু নন। মালিক স্বয়ং মা কালী। মথুরবাবু মায়ের নিযুক্ত দেওয়ান। এখন মায়ের প্রজারাই যদি কষ্টে থাকে, তাহলে দেওয়ান হয়ে কেন তিনি তাঁদের দুঃখ মোচন করবেন না? এরপর অবশ্য আর মথুরবাবুর না বলার কিছু থাকে না। তার উপর তিনি নিজেও সহৃদয় মানুষ। সে যাত্রা ঠাকুরের উদ্যোগেই সাধারণ মানুষগুলো অসহ্য কষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। অন্যদিকে সাধারণের প্রতি জমিদারদের বা বিত্তশ্রেণীর মানুষের যে কীরকম আচরণ হওয়া উচিত, ঠাকুর তাও যেন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেদিনের কাজে। অথচ ঠাকুর তো সাধক। আধ্যাত্মিক পথেই তাঁর থাকার কথা। কিন্তু ধর্ম যে জনজীবনকে বাদ দিয়ে নয়, এই সত্যি সেদিনই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঠাকুর।
এইভাবে জনসেবা ও ধর্মরক্ষা করতে ঠাকুরকে আমরা এরপরেও দেখব। শুনব সে কথা।