সহজে কাউকে গুরু বলে স্বীকার করে নেবার মানুষ নন নরেন্দ্রনাথ। এ ব্যপারে তাঁর স্পষ্ট মত আছে। নিজেরই মতো একজন দুর্বল, স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষকে হঠাৎ গুরু বলে স্বীকার করে নিতেই বা হবে কেন! আর গুরু বলা মানেই তাঁর সমস্ত কথা বিনা নির্দেশে পালন করতে হবে বা তাঁকেই অধ্যাত্মজগতের পথপ্রদর্শক হিসাবে স্বীকার কর নিতে হবে। এ যেন ঠিক মেনে নিতে পারতেন না নরেন্দ্রনাথ।
ঠাকুর তো নরেন্দ্রনাথের থেকে যা জানার তা জেনেই নিয়েছেন। যা বোঝার বুঝেও নিয়েছেন। এবার নরেন্দ্রনাথের পালা। এবার তিনিও বুঝে নিতে চাইবেন ঠাকুরকে। দুজন দুজনকে চিনে না নিলে বৃত্ত সম্পূর্ণই বা হবে কেমন করে! এই যে তিনি নরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র, তিনিও তো সাধারণ মানুষটি নন। নরেন্দ্রনাথ খানিকটা হলেও জানেন তাঁর মনের গঠন। তাঁর সঙ্গে যে অদ্ভুত ঘটনাগুলো হয়, সেগুলো যে-কোনও মানুষের সঙ্গে যে হতে পারে না, তা তিনি জানতে পেরেছেন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৬): অখণ্ডের রাজ্যে যে ঋষিকে দেখেছিলেন ঠাকুর, তিনিই নরেন্দ্রনাথ
এরকম কারই-বা হয়? নরেন্দ্রনাথ চোখ দুটো বন্ধ করলেই দেখতে পান, দুই ভুরুর মধ্যে জেগে উঠেছেন এক জ্যোতি-বিন্দু। সেই বিন্দুর উপর তিনি মন একাগ্র করেন। দেখেন বিন্দুটি নানা রূপ ধারণ করছে। নানারভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। ছোট্ট বিন্দুটি ক্রমশ বাড়তেও থাকে। তারপর একসময় যেন বুদবুদের মতো ফেটে যায়। তখন তরল জ্যোতির ধারা নেমে আসে আর নরেন্দ্রনাথ ঘুমিয়ে পড়েন। জ্যোতির্ময় সেই বিন্দুটিকে দেখার জন্য মানুষ যেভাবে মাটিতে মাথা ঠেকায়, সেভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতেন নরেন্দ্রনাথ। বহুদিন পর্যন্ত তিনি ভাবতেন, আর সকলেরই বোধহয় ওভাবেই ঘুম আসে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৫): ঠাকুরের স্পর্শে আবার বাহ্যজ্ঞান লোপ হল নরেন্দ্রনাথের
একটু বয়স হতে যখন ধ্যান অভ্যাস করছেন, তখনও দেখতেন ধ্যানের জন্য চোখ বন্ধ করলেই ওই জ্যোতির বিন্দু সামনে চলে আসে। অনেকদিন পর একবার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর কথা হচ্ছিল। মহর্ষি ও অন্যান্যরা তাঁদের ধ্যান অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন। সেই কথা শুনতে গিয়ে নরেন্দ্রনাথের উপলব্ধি হল যে, সকলের ঐরকম দর্শন হয় না। আর সকলের ওভাবে ঘুমও আসে না। নরেন্দ্রনাথ যেন বুঝতে পারছিলেন, তিনি কোথাও একটু স্বতন্ত্র।
আরও শুনুন- শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৪): ঠাকুর যেন এক রহস্যের খনি, বিস্ময়ে অনুভব করলেন নরেন্দ্রনাথ
আর-একটি ঘটনাও ঘটত তাঁর সঙ্গে। অনেক জায়গা বা বস্তু দেখে তাঁর মনে হত, এ যেন তিনি আগেই দেখেছেন। গোড়ার দিকে নিজের মনে এর নানা ব্যাখ্যা করেছিলেন। ভেবেছিলেন জন্মান্তর বা পুনর্জন্মের কারণে বুঝি বা এরকম হয়। পরে বুঝলেন, তা ঠিক নয়। এ জীবনে তাঁর সঙ্গে যা যা ঘটবে, যা যা তিনি দেখবেন, সে সব যেন আগেই তিনি দেখে রেখেছেন। যেন সব ঠিক করাই আছে। সেই দেখে-রাখা পথ ধরেই এগোচ্ছেন নরেন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩): ঠাকুর পা তুলে দিলেন কোলে, নরেন্দ্রনাথের সামনে দুলে উঠল গোটা বিশ্ব
তবে সে যাই হোক, সহজে কাউকে গুরু বলে স্বীকার করে নেবার মানুষ নন নরেন্দ্রনাথ। এ ব্যপারে তাঁর স্পষ্ট মত আছে। নিজেরই মতো একজন দুর্বল , স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষকে হঠাৎ গুরু বলে স্বীকার করে নিতেই বা হবে কেন! আর গুরু বলা মানেই তাঁর সমস্ত কথা বিনা নির্দেশে পালন করতে হবে বা তাঁকেই অধ্যাত্মজগতের পথপ্রদর্শক হিসাবে স্বীকার কর নিতে হবে। এ যেন ঠিক মেনে নিতে পারতেন না নরেন্দ্রনাথ। দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর প্রথমদিন তাঁকে যে সব কথা বলেছিলেন, তা শুনে তাঁর মনে হয়েছিল, মানুষটা অর্ধোন্মাদ। পরের দুদিনে যখন ঠাকুরের ছোঁয়ায় তাঁর জ্ঞান লোপ হল, তখন একটু করে যেন মন বদলাতে থাকল নরেন্দ্রনাথের। তিনি বুঝতে পারছেন, ঠাকুর মহাপুরুষ। তিনি চাইলেই তাঁর মতো শক্ত মনের মানুষের মনকেও উচ্চপথে চালিত করতে পারেন। এই আশ্চর্য ক্ষমতা তো সবার থাকে না। তিনি যে তাঁকে আশীর্বাদ করেছেন সে-ও তাঁর কম ভাগ্য নয়।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২): ঠাকুরের আচরণ দেখে নরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন মানুষটা ‘অদ্ভুত পাগল’
মহাপুরুষের দেখা পাওয়া বিরল ঘটনাই বটে। তবে কেউ কেউ তো থাকেন সেরকম। তাঁদের ত্যাগ, তপস্যা প্রেমে তাঁরা এতদূর এগিয়ে যান যে সাধারণ মানুষের ঈশ্বর সম্বন্ধীয় ধারণা তার নাগাল অব্দি পায় না। নরেন্দ্রনাথ বুঝতে পারছিলেন, ঠাকুর সেরকমই একজন অসীম শক্তিধর পুরুষ। যে নরেন্দ্রনাথ সহজে কাউকে গুরু হিসাবে মেনে নিতে পারতেন না, এবার ঠাকুরকে গুরুর আসনে বসাতে মনে মনে সম্মত হলেন। তবে তাই বলে ঠাকুরের সব কথা কি নির্বিচারে মেনে নেবেন! এখনও যেন খানিক সংশয়ের মেঘ ঝুলে রইল যুবক নরেন্দ্রনাথের মনে।