সেদিন বারান্দা থেকে যখন ঘরে এসে বসলেন, তখন নরেন্দ্রনাথও অপলকে দেখছেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণকে। ঠাকুর এতদিনে চিনেছেন তাঁকে। এবার শিষ্যও চিনে নিক গুরুকে। কী বলছেন ঠাকুর? নরেন্দ্রনাথ বিস্ময়ে খেয়াল করলেন, কোনও ভণিতা না করেই ঠাকুর স্পষ্ট বলছেন, তোমাদের যেমন দেখছি, যেমন করে তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি, সেভাবেই ঈশ্বরকেও দেখা যায়। তাঁর সঙ্গে কথ বলা যায়। এত স্পষ্ট কথা যেন এর আগে আর শোনেননি নরেন্দ্রনাথ।
[ শুনুন প্রথম পর্ব: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১): তিনি নররূপী নারায়ণ, এসেছিলেন জীবের দুর্গতি নিবারণে ]
‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীরধারণ করিয়াছ’- বলছেন ঠাকুর। আর কাঁদছেন। ভক্তের মতো দেবতার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। নরেন্দ্রনাথকে কাছে পেয়ে তাঁর আনন্দের বাঁধ যেন ভেঙে গিয়েছে। দক্ষিণেশ্বরের সেই ছোট্ট ঘরের বারান্দায় তখন এক অপ্রাকৃত মুহূর্ত জন্ম নিয়েছে। এক অপূর্ব লীলার সূচনা। নরেন্দ্রনাথকে ঠাকুর বললেন, একটু দাঁড়াতে। তারপর দ্রুত একবার ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। পরক্ষণেই বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। হাতে মাখন, মিছরি আর কতকগুলো সন্দেশ। নিজের হাতে করে তিনি নরেন্দ্রনাথকে সেগুলো খাইয়ে দেবেন। যুবক নরেন্দ্রনাথ তো এতে ভারী বিব্রত। বিড়ম্বনায় পড়ে বলছেন, আমায় ওগুলো দিন। আমি নিজে খাচ্ছি। বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে খাচ্ছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা ! ঠাকুর বলছেন, ওরা খাবেখন। আগে তুমি খাও। ঠাকুরের সেই জোরের কাছে যুবক নরেন্দ্রনাথ যেন বালকটি। ঠাকুরের তাঁকে হাতে তুলে খাওয়াচ্ছেন। আর বলছেন, বলো আবার আসবে! এবার কিন্তু একা এসো কেমন! সকলের সঙ্গে নয়! যুবক নরেন্দ্রনাথ খানিকটা বিহ্বল। কিছুটা বিস্মিত। যা কিছু হচ্ছে, তা যেন তাঁর ভাবনাত অতীত। ঠাকুরের জোরাজুরিতে তিনিও বলে ফেললেন, আচ্ছা আসব। মানুষটার ওইরকম আচার আচরণ দেখে যুবক নরেন্দ্রনাথের সেদিন মনে হয়েছিল, লোকটা যেন অদ্ভুত পাগল।
আরও শুনুন: কেন কল্পতরু হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ?
ঠাকুরের কাছে আর পাঁচজন ভক্ত যাঁরা যান, যুবক নরেন্দ্রনাথ তো তাঁদের মতো নন। সংসারের জ্বালা ভুলতে বা বিষয়-বিষ থেকে মুক্তি পেতে তিনি ঠাকুরের কাছে ছুটে যাননি। তাঁর নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। খোঁজ আছে। কী সেই খোঁজ? খোঁজ সেই পরম সত্যের। বহুদিন থেকেই তিনি ব্রহ্মচর্য পালন করছেন। গোপনে কঠোর তপস্যা করছেন। তাঁর পিতামহ তো সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। যুবক নরেন্দ্রনাথের মনেও বইছ বৈরাগ্যের গৈরিক হাওয়া। নিজের বাড়ির কাছেই নরেন্দ্রনাথের মাতামহীর একখানা বাড়ি ছিল। তারই দোতালায় একখানা ঘরে যুবক আলাদা থাকেন। বাড়ির সকলে জানেন যে, তাতে পড়াশোনায় সুবিধা হয়। যুবক নরেন্দ্রনাথ সেই নির্জনে বসে সাধন করেন। ধ্যানে তাঁর প্রবল অনুরাগ। ব্রাহ্মসমাজেও তাঁর যাতায়াত আছে। তবে এই সাকার-নিরাকারের দ্বন্দ্ব, একটা মতের প্রতিষ্ঠা – এইসব তাঁকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারে না। ধরে নেওয়া গেল, ঈশ্বর নিরাকার। সেই নিরাকার সগুণ-ব্রহ্মের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাঁর ধ্যান তো তিনি করেই থাকেন। কিন্তু এই কি সব! তাঁর বারেবারে মনে হয়, ঈশ্বর যদি থাকেন, তাহলে ভক্তের কাতর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি স্বরূপ প্রকাশ করবেন নাই-বা কেন! তাঁর অতীতের সমস্ত সংস্কার, ধারণা তাঁকে ক্রমাগত এই কথাই বলতে থাকে। একটা দোলাচলের ভিতর দুলতে থাকেন তেজস্বী যুবক। আর নিভৃতে করে চলেন সাধনা। সত্যিটা তাঁকে জানতেই হবে? কোথায় কীভাবে সেই পরম সত্যের প্রকাশ? বের করতেই খুঁজে হবে।
আরও শুনুন: মানুষ কি নিজের মন্দ কাজের ভারও ঈশ্বরের উপর চাপাতে পারে?
সেই খোঁজই যেন সম্পূর্ণ হচ্ছে দক্ষিণেশ্বরে। সেদিন বারান্দা থেকে যখন ঘরে এসে বসলেন, তখন নরেন্দ্রনাথও অপলকে দেখছেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণকে। ঠাকুর এতদিনে চিনেছেন তাঁকে। এবার শিষ্যও চিনে নিক গুরুকে। কী বলছেন ঠাকুর? নরেন্দ্রনাথ বিস্ময়ে খেয়াল করলেন, কোনও ভণিতা না করেই ঠাকুর স্পষ্ট বলছেন, তোমাদের যেমন দেখছি, যেমন করে তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি, সেভাবেই ঈশ্বরকেও দেখা যায়। তাঁর সঙ্গে কথ বলা যায়। এত স্পষ্ট কথা যেন এর আগে আর শোনেননি নরেন্দ্রনাথ। ঠাকুর বলছেন, কিন্তু ওরকম করে ঈশ্বরকে দেখতে চায় কে? সকলে স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের জন্য কেঁদে ভাসায়? ঈশ্বরের জন্য কে ব্যাকুল? কে তেমন করে কাঁদে? শুনতে শুনতে ভিনদেশি দার্শনিকদের উক্তি মনে পড়ছিল নরেন্দ্রনাথের। মনে মনে ভাবছিলেন, এই ব্যক্তি নির্ঘাত অর্ধোন্মাদ। পরক্ষণেই তাঁর মনে হল, উন্মাদ হলেও ইনি মহাপবিত্র, মহাত্যাগী। এমন একজন মানুষ, মন থেকে যার প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করা যায়।
সেদিনকার মতো দক্ষিণেশ্বর থেকে চলে গেলেন নরেন্দ্রনাথ। তখনও বোধহয় তিনি বুঝতে পারেননি, এই অদ্ভুত পাগলের সঙ্গেই এক অলক্ষ টানে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। নক্ষত্র আর গ্রহের ভিতর থাকে সেই টান। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আর সেই টানেই বয়ে চলবে ভারতীয় সাধনার নিরন্তর ধারা। এবার তা বইবে নতুন স্রোতে, নতুন খাতে।