রানিমা নিজেও অন্যরকম মানুষ। তাই তিনি বুঝলেন, মা স্বয়ং তাঁর দোষ ধরিয়ে দিলেন গদাধরের মাধ্যমে। মায়ের সঙ্গে গদাধরের সত্যিই যে সম্পর্ক যোগাযোগ আছে – সে ব্যাপারে রানিমা যেন নিঃসংশয় হলেন।
ঠাকুর যে একজন আশ্চর্য মানুষ – সে পরিচয় পেয়েছিলেন রানি রাসমণি স্বয়ং। যখন মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাকে সামাজিক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল, তখন ঠাকুরের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বলা যায়, রামকুমারবাবু সেদিন না থাকলে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে আরও ক্লেশ সহ্য করতে হত রানিমাকে। কিন্তু শুধু সেই কারণেই যে তিনি রামকুমারের ভাই গদাধরকে স্নেহ করতেন, তা নয়। একদিনের ঘটনায় তিনি নিজেও বুঝেছিলেন ঠাকুর ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২০): ঠাকুরের পুজোর ধরনে রেগে আগুন কর্মচারীরা, পাশে ছিলেন রানিমা
রানিমা সেদিন মন্দিরে এসেছেন। ঠাকুর ভজন গাইছেন। রানিমা তাই-ই শুনছেন তন্ময় হয়ে। হঠাৎ তাঁর চিন্তাস্রোত ছিন্ন হল। মন পাড়ি দিল অন্যদিকে। একটা মামলার বিষয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন তিনি। ভজন শুনতে শুনতে সেই মামলার কথাই কেবল মনে ঘুরে ফিরে এল। কেউ কিচ্ছুটি টের পেল না। সকলেই ভাবলেন, রানিমা একমনে ভজন শুনছেন। কিন্তু তিনি তখন ডুবে গিয়েছেন মামলার বিষয়ে। কিন্তু টের পেল না বললে আর কী হবে! যিনি বোঝার তিনি ঠিক বুঝলেন। ঠাকুর খেয়াল করেছিলেন সবই। একসময় রানিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে তিনি বললেন, এইখানে বসেও ঐ চিন্তা! চমকে উঠলেন রানিমা। তাঁর মনের ভিতর কী চলছে তা এই পূজারী জানলেন কী করে!
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৯): কবরস্থানে বসেও মা ভবতারিণীর ধ্যান করেছিলেন ঠাকুর
ঠাকুর যেভাবে রানিমাকে সেদিন তিরস্কার করেছিলেন, সাধারণের চোখে তা হয়তো গর্হিত কাজ। রানিমা স্বয়ং মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। আর ঠাকুর সেখানে তাঁর কর্মচারী। কিন্তু সেদিন রানিমা নিজের দোষেই লজ্জিতা হলেন। বুঝলেন, দেবস্থানে এসে বিষয়চিন্তা করা তাঁর উচিত হয়নি। তাতে তাঁর দোষই হয়েছে। আর ঐশী ক্ষমতাবলেই সে কথা বুঝতে পেরেছেন এই তরুণ পূজারী। এর আগেও তিনি গদাধরের সম্পর্কে, তাঁর আচার ব্যবহার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন। মনে করেছিলেন, মা কালীর ইচ্ছাতেই তিনি এমন কাজ করে থাকেন। এদিন যেন সেই বিশ্বাস আরও পাকা হল। রানিমা নিজেও অন্যরকম মানুষ। তাই তিনি বুঝলেন, মা স্বয়ং তাঁর দোষ ধরিয়ে দিলেন গদাধরের মাধ্যমে। মায়ের সঙ্গে গদাধরের সত্যিই যে সম্পর্ক যোগাযোগ আছে – সে ব্যাপারে রানিমা যেন নিঃসংশয় হলেন। কর্মচারী হলেও, ঠাকুরের সেই শাসন সেদিন তাই তিনি নতমস্তকে গ্রহণ করেছিলেন। মন্দির থেকে যাবার আগে বলে গেলেন, কেউ যেন এবিষয়ে আর একটা কথাও না বলেন। কোনোভাবে গদাধর আঘাত পান বা দুঃখ পান, এ তিনি চান না। ঠাকুর যে নিজের মতো করে সেদিন নিজের সাধনের পথে এগোতে পেরেছিলেন, তাঁতে রানিমার এই সস্নেহ প্রশ্রয় যেন ছিল মায়ের আশীর্বাদের মতোই।