যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মীয়দের রণসজ্জায় সজ্জিত দেখে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন অর্জুন। সেই বিষাদ কাটানোর দায়িত্ব নেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। সেদিন তিনি অর্জুনকে যা বলেছিলেন, তাই-ই গীতার জ্ঞানরাশি হিসাবে মানবসমাজে প্রচারিত। প্রশ্ন, এই জ্ঞান কি তখনই উদ্ভূত? নাকি এই জ্ঞান আগেও ছিল? ভগবান কি অর্জুনের আগেও কাউকে দিয়েছিলেন এই অমূল্য উপদেশ? শুনে নিন।
শ্রীগীতায় ভগবান নিজের মুখে অর্জুনকে বলেছিলেন, অধর্ম বিনাশের জন্য, ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যুগে যুগে আবির্ভূত হন। এই কথার মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, ভগবান শুধুমাত্র অর্জুনের সময়কালে এসেছেন তা নয়, আগেও এসেছেন; পরেও আসবেন; আর তাঁর অমূল্য বাণী তিনি জগৎবাসীকে শুনিয়েছেন, মানুষকে উদ্ধার করতে। এই জগতের যা কিছু ক্লেশ, মায়া ও মোহ, তা থেকে উত্তরণ ঘটাতেই ভগবান এই অমূল্য জ্ঞানরাশি উপহার দেন জগৎবাসীকে।
আরও শুনুন: রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন সাধকরা, কী কী ফল মেলে এতে?
এই যে জ্ঞান, তা শাশ্বত। চিরন্তন। সময়ের আবর্তে কখনও সখনও তা ঢাকা পড়ে যায়। তখনই উত্থান ঘটে অধর্মের। আর সেই কালিমা মোচনের জন্য নেমে আসতে হয় ভগবানকে, অবতার রূপে। অর্জুন বিষাদযোগে সেই চিরন্তন জ্ঞানের কথাই আবার বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এর আগে এই জ্ঞানরাশি উন্মুক্ত হয়েছিল কার কাছে? সে উত্তরও দিয়েছেন কৃষ্ণ স্বয়ং। জ্ঞানযোগের শুরুতেই অর্জুনকে তিনি তাই জানাচ্ছেন, ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্ – অর্থাৎ বহুযুগ আগে এই যোগশাস্ত্রের শিক্ষা তিনি দিয়েছিলেন বিবস্বানকে। বিবস্বান আবার তা শিখিয়েছিলেন মনুকে। মনুর থেকে এই অব্যয়যোগ পান ইক্ষ্বাকু। এইভাবেই পরম্পরাক্রমে প্রবাহিত হচ্ছিকল এই জ্ঞানরাশি। সেই জ্ঞান বিদিত ছিলেন রাজর্ষিগণ। ভগবান বলছেন, ইহলোকে নানা কারণে সেই জ্ঞান নষ্ট হয়েছে বলেই তিনি আবার অর্জুনকে সেই বাণী শোনাচ্ছেন। অর্জুন তাঁর ভক্ত এবং সখা। তাই এই গুহ্য তত্ত্ব তিনি অর্জুনের সামনে প্রকাশ করছেন।
আরও শুনুন: ভাগ্য ফেরাতে অগ্রহায়ণ মাসে কোন কোন দেবতার পুজো করা উচিত?
এখন অর্জুনের মনে প্রশ্ন জাগে, কৃষ্ণ তো তাঁর সময়ের। আর বিবস্বানের জন্ম বহু পূর্বে। তাহলে কৃষ্ণ বিবস্বানকে এই জ্ঞান দান করলেন কীভাবে? এই কথা অর্জুন বলে ফেললেন, কেননা কৃষ্ণের অবতার তত্ত্ব তিনি জানতেন না। ভীষ্ম, বিদুরের মতো জ্ঞানীরা, প্রাজ্ঞজনেরা কৃষ্ণকে ঈশ্বর জ্ঞান করতেন। কিন্তু অর্জুন তাঁকে সখা হিসেবে দেখেছেন। কৃষ্ণও অর্জুনের সঙ্গে সেরকম ব্যবহারই করেছেন। কৃষ্ণের এই লীলার মাধুর্য তো আত্মগোপনেই। তাই অর্জুনের মনে এহেন প্রশ্নের উদয়। আসলে আমরা বুঝতে পারি, এ প্রশ্ন আমাদের সকলের, সকল ভক্তের। যে, ভগবান তাঁর এই ঋত জ্ঞান আগেও কীভাবে দান করেছিলেন? এরই উত্তরে ভগবান জানাচ্ছেন। অর্জুনের সকল সংশয় দূর করে বলছেন, হে অর্জুন আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। অর্থাৎ কৃষ্ণ অর্জুন দুজনেই বহুবার জন্মেছেন। কিন্তু অর্জুন তা জানেন না, কৃষ্ণ জানেন। অর্থাৎ অর্জুন এখানে খণ্ডিত সত্তা। নির্দিষ্ট সময়কালে আবদ্ধ। কৃষ্ণ অখণ্ড সত্তা। তিনি অবিদ্যা আর অজ্ঞান দ্বারা আবৃত নন। তাই অর্জুনের জ্ঞানসূত্র ছিন্ন হলেও, কৃষ্ণের হয়নি। এইখানেই শ্রীকৃষ্ণ জানাচ্ছেন, অধর্মের উত্থান হলে দুষ্কৃতীদের বিনাশের জন্যই তিনি আবির্ভীত হয়েছেন- ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।
বাকি অংশ শুনে নিন।