সাকার-নিরাকারের দ্বন্দ্বটা তো থেকেই যাচ্ছে। ঠাকুরের কিছু নিরাকার ভক্তও তো ছিলেন। সামঞ্জস্য আনতে ঠাকুর বলতেন, “নিরাকার দু-রকম আছে, পাকা ও কাঁচা। পাকা নিরাকার উঁচু ভাব বটে; সাকার ধরে সে নিরাকারে পৌঁছুতে হয়। কাঁচা নিরাকারে চোখ বুজলেই অন্ধকার – যেমন ব্রাহ্মদের।” বলতেন, “ওরে, তিনি সাকারও বটে আবার নিরাকারও বটে, আবার তা ছাড়া আরও কি তা কে জানে? সাকার কেমন জানিস – যেমন জল আর বরফ। জল জমেই বরফ হয়; বরফের ভিতরে বাহিরে জল। জল ছাড়া বরফ আর কিছুই নয়। কিন্তু দ্যাখ, জলের রূপ নেই (একটা কোন বিশেষ আকার নাই), কিন্তু বরফের আকার আছে। তেমনি ভক্তিহিমে অখণ্ড সচ্চিদানন্দসাগরের জল জমে বরফের মতো নানা আকার ধারণ করে।”
সব ভক্তদের সঙ্গে ঠাকুরের ব্যবহার একরকম ছিল না। সে কথা আমরা আগেই শুনেছি। যার যেরকম সমস্যা বা প্রয়োজন, ঠাকুর তাঁর মতো করে সেই সমস্যার সমাধান করতেন। বাতলে দিতেন পথ। যাতে তিনি এগিয়ে যেতে পারেন ঈশ্বর উপাসনার দিকে।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩৩): ধ্যানের সময় মন চঞ্চল শিষ্যার, অভিনব উপায় বলে দিলেন ঠাকুর
ঠাকুরের সন্ন্যাসী ভক্তদের কেউ কেউ বলেছেন, ঠাকুর আসলে তাঁর ভক্তদের দুটি শ্রেণি বা থাক-এ ফেলতেন। একদল শিবের অংশ সম্ভূত। অন্যদল বিষ্ণুর অংশ সম্ভূত। এই দুই শ্রেণির ভক্তদের আচার, ব্যবহার ঈশ্বর অনুরাগের মধ্যে পার্থক্য থাকত। কিন্তু ঠাকুর যে কী করে তা চিহ্নিত করতেন তা তিনিই জানেন। মোটকথা, সব ভক্তদের জন্য তিনি এক নিয়ম জারি করেননি। প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে ঠেলে দিয়েছেন ঈশ্বরলাভের পথে। ঠাকুর নিজেকেও সেইমতো বদলে দিতেন। ভক্তদের কারও সঙ্গে তাঁর সখ্যভাব, কারও সঙ্গে দাস্য বা বাৎসল্যের ভাব। নরেন্দ্রনাথকে দেখিয়ে ঠাকুর বলতেন, ও হল আমার শ্বশুরঘর। আবার রাখাল মহারাজকে নিজের পুত্রসমান বিবেচনা করতেন। এইরকম সকলের প্রতি পৃথক ভাব, আলাদা ব্যবহার কেন করতেন? উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন, “মানুষগুলোর ভেতর কি আছে, তা সব দেখতে পাই; যেমন কাচের আলমারির ভেতর যা যা জিনিস থাকে সব দেখা যায়, সেই রকম।” তাই তো প্রতি ভক্তের জন্য অন্যরকম ব্যবহার। ভক্তপ্রবর গিরিশের অনেক আবদার, শক্ত শক্ত কথা তাই তিনি হেসে সহ্য করে নিতেন। কেননা তিনি জানতেন, গিরিশের ভক্তি এবং বিশ্বাস খাঁটি। সেখানে কোনও ভেজাল নেই।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩২): ভক্তের ইচ্ছা সমাজসেবা করার, ঠাকুর তাঁকে কী বললেন?
ঠাকুরের ভক্তদের মধ্যে যাঁরা সাকারবাদী, তাঁদের বলতেন, “ধ্যান করবার সময় ভাববে, যেন মনকে রেশমের রশি দিয়ে ইষ্টের পাদপদ্মে বেঁধে রাখচ, যেন সেখান থেকে আর কোথাও যেতে না পারে। রেশমের দড়ি বলছি কেন? – সে পাদপদ্ম যে বড় নরম। অন্য দড়ি দিয়ে বাঁধলে লাগবে তাই।” বলতেন, “ধ্যান করবার সময় ইষ্টচিন্তা করে তারপর কি অন্য সময় ভুলে থাকতে হয়? কতকটা মন সেইদিকে সর্বদা রাখবে। দেখেচ তো, দুর্গাপূজার সময় একটা যাগ-প্রদীপ জ্বালতে হয়। ঠাকুরের কাছে সর্বদা একটা জ্যোৎ (জ্যোতিঃ) রাখতে হয়, সেটাকে নিবতে দিতে নেই। নিবলে গেরস্তর অকল্যাণ হয়। সেইরকম হৃদয়পদ্মে ইষ্টকে এনে বসিয়ে তাঁর চিন্তারূপ যাগ-প্রদীপ সর্বদা জ্বেলে রাখতে হয়। সংসারের কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে ভেতরে চেয়ে দেখতে হয়, সে প্রদীপটা জ্বলচে কিনা।” এই জাগপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা তো সহজ কাজ নয়। ঠাকুর তাই বলতেন, “ওগো, তখন তখন ইষ্টচিন্তা করবার আগে ভাবতুম, যেন মনের ভেতরটা বেশ করে ধুয়ে দিচ্ছি! মনের ভেতর নানান আবর্জনা, ময়লা-মাটি (চিন্তা, বাসনা ইত্যাদি) থাকে কিনা? সেগুলো সব বেশ করে ধুয়ে ধেয়ে সাফ্ করে তার ভেতর ইষ্টকে এনে বসাচ্চি! – এই রকম করো!”
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ৩১): গুরুর বাণীর রহস্য জগৎবাসীকে শোনানোর প্রতিজ্ঞা নরেন্দ্রনাথের
এই পরামর্শ তিনি দিচ্ছেন ঠিকই। ভক্তরা উপকৃতও হচ্ছেন। কিন্তু সাকার-নিরাকারের দ্বন্দ্বটা তো থেকেই যাচ্ছে। ঠাকুরের কিছু নিরাকার ভক্তও তো ছিলেন। সামঞ্জস্য আনতে ঠাকুর বলতেন, “নিরাকার দু-রকম আছে, পাকা ও কাঁচা। পাকা নিরাকার উঁচু ভাব বটে; সাকার ধরে সে নিরাকারে পৌঁছুতে হয়। কাঁচা নিরাকারে চোখ বুজলেই অন্ধকার – যেমন ব্রাহ্মদের।” বলতেন, “ওরে, তিনি সাকারও বটে আবার নিরাকারও বটে, আবার তা ছাড়া আরও কি তা কে জানে? সাকার কেমন জানিস – যেমন জল আর বরফ। জল জমেই বরফ হয়; বরফের ভিতরে বাহিরে জল। জল ছাড়া বরফ আর কিছুই নয়। কিন্তু দ্যাখ, জলের রূপ নেই (একটা কোন বিশেষ আকার নাই), কিন্তু বরফের আকার আছে। তেমনি ভক্তিহিমে অখণ্ড সচ্চিদানন্দসাগরের জল জমে বরফের মতো নানা আকার ধারণ করে।”
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৯): মানুষ বড় কাঁদছে, মথুরবাবুকে বলে তাঁদের অন্নের ব্যবস্থা করলেন ঠাকুর
এই নিরাকারবাদীদের মধ্যে একসময় ছিলেন নরেন্দ্রনাথও। তিনি তো আর সহজ কথায় ভুলবার মানুষ নন। সাকারবাদীদের সঙ্গে তাঁর তর্ক হত। তা দেখে আনন্দ পেতেন ঠাকুর। বলতেন, “অমুকের কথাগুলো নরেন্দর সে দিন ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ করে কেটে দিলে! – কি বুদ্ধি!” কিন্তু গিরিশের সঙ্গে যেদিন তর্ক বাঁধল এই নিয়ে সেদিন তাকে থেমে যেতে হল। ওই যে এমরা বলছিলাম, আলাদা ভক্তের জন্য ঠাকুরের আলাদা ভাব। নরেন্দ্রনাথ যুক্তিবাদী, তার্কিক। তাকে তো তাঁর মতো করেই উত্তর দিতে হবে। তাই নরেন্দ্রনাথ যখন সাকারবাদীদের ঈশ্বরভক্তিকে একদিন অন্দবিশ্বাস বললেন, ঠাকুর পালটা বললেন, “আচ্ছা, অন্ধবিশ্বাসটা কাকে বলিস আমায় বোঝাতে পারিস? বিশ্বাসের তো সবটাই অন্ধ; বিশ্বাসের আবার চক্ষু কি? হয় বল ‘বিশ্বাস’, আর নয় বল ‘জ্ঞান’। তা নয়, বিশ্বাসের ভেতর আবার কতকগুলো অন্ধ আর কতকগুলোর চোখ আছে – এ আবার কি রকম?”
ঠাকুর জানতেন তাঁর এই ভক্তটি একেবারেই আলাদা। তাই তাকে তাঁর মতো করেই যুক্তি দিলেন। আর তা শুনে নিরুত্তর নরেন্দনাথ। পরে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “বাস্তবিকই সেদিন আমি ঠাকুরকে অন্ধবিশ্বাসের অর্থ বুঝাইতে যাইয়া ফাঁপরে পড়িয়াছিলাম। ও কথাটার কোন অর্থই খুঁজিয়া পাই নাই। ঠাকুরের কথাই ঠিক বলিয়া বুঝিয়া সেদিন হইতে আর ও কথাটা বলা ছাড়িয়া দিয়াছি।”
ঠাকুরের যুক্তির কাছে সেদিন হারই মানতে হয়েছিল অতিবড় যুক্তিবাদী নরেন্দ্রনাথকে।