মাতৃপক্ষ। মায়ের কাছেই সকল চাওয়া। চোখ বন্ধ করে। খোলা চোখে অবশ্য অপ্রাপ্তি। বিস্তর। মা আর মেয়েদের পাওনার ঘরে ঘরে আজও মস্ত ঢ্যাঁড়া। সেই কথা নতুন করে বলাই হোক এবারের অঞ্জলি মন্ত্রে। হয়তো এ অন্যরকম, অথবা এ-ই স্বাভাবিক।
দেবীপক্ষে নারী এবং পুরুষের একই কাজে সমবেতনের দাবি জানালেন অরুন্ধতী দাশ। পড়ে শোনাচ্ছেন, চৈতালী বক্সী। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
অটোর পিছনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছি, আচমকা চটক ভাঙল চালকের একেবারে কাঁসানিন্দিত গলায় কাঁচা গালাগালিতে। সামনের একটা গাড়ি একটু ঢিমে তেতালায় এগোচ্ছে, তাইতেই এত রাগ! আর পাঁচটা রাস্তার চিৎকার মাথা থেকে যেমন ঝেড়ে ফেলি, এটার পরিণতিও তেমনই হতে যাচ্ছিল। হঠাৎ শুনলাম চালক বলছে, “সবকিছু করা চাই, সব, স-অ-ব একেবারে করা চাই না? মদ্দ হওয়ার শখ একেবারে ঘুচিয়ে দেব!” চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি, পাশের গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে বসেছেন এক মহিলা, তাঁকে উদ্দেশ্য করেই এই চিৎকার। অটোর ভেতর-বাইরে থেকে খানিক রাগারাগি হল ঠিকই, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, অটোয় আমি-সহ পিছনে সেদিন বসে ছিলাম আরও তিনজন মেয়ে। আমাদের সবার সামনেই এই কুৎসিত কদর্য আক্রমণটা শানাতে সেদিন ওই চালকের কিন্তু গলা কাঁপেনি। কাঁপেও না, কারণ চৌরাস্তার মাছবাজার হোক বা চৌরঙ্গির অফিসপাড়া, চৌপহর ‘মেয়েদের কাজ’ বনাম ‘মেয়েলি কাজ’-এর এই বিভাজন গেড়ে বসে থাকে।
আর এই কাজের বিভাজনটাও আসে একেবারে টাকার হিসেব ধরে। যে ধরনের শ্রম কেনার জন্য বেশি টাকা খরচ করতে হয়, সেই কাজ পুরুষের। কিছু সমঝোতাকামীরা অবশ্য বোঝাতে আসেন যে, শারীরবৃত্তীয় কারণেই কায়িক শ্রমের কাজগুলি পুরুষের হওয়া দস্তুর, ওতে খুব একটা বৈষম্য নেই। তাদের জন্য বলি, এই অদ্ভুত শহরকেন্দ্রিক ভুঁইফোঁড় ধারণার সঙ্গে কিন্তু শ্রম-অর্থনীতির তথ্যগত কোনও সামঞ্জস্যই নেই! অবিভক্ত বাংলা যখন ছিল, সেই সময় থেকেই মেয়েদের কাজে অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলেছে শ্রমের আধুনিকীকরণ। আধুনিক শিল্প আসার আগে, কৃষিকাজের পরিপূরক ধান রোয়া, ধানের তুষ আলাদা করা, ঢেঁকিতে চাল কোটা জাতীয় যাবতীয় কাজ মেয়েরাই করত। কিন্তু ১৯৮৩ এবং ১৯৮৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চালকল আর সুতোকল যখন থেকে শ্রমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল, ব্যাপক পরিমাণ মেয়েরা বেকার হয়ে গেল এক লহমায়। ধানচাষের পরিপূরক এই কাজগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এতদিন করতেন বাড়ির মেয়েরা, পরিবারের গৃহসহায়িকারা। নির্দিষ্ট শ্রম বাবদ মূল্য বুঝে নেওয়ার স্পষ্টতা স্বাভাবিকভাবেই এই অসংগঠিত উপরন্তু পারিবারিক কর্মক্ষেত্রগুলোতে কোথাওই নেই। একই বিষয় দেখবেন রাঁধাবাড়া এবং গেরস্থালির ক্ষেত্রেও। বাড়ির ভেতরে, মেয়েরা রান্নাবান্না এবং ঘর সামাল দিতে খেটে চলেছেন ঠিক পেটচুক্তির শ্রমিকের মতো। অথচ, সেই কাজটার দামই যখন মজুরি দিয়ে নির্ধারণ করা হচ্ছে, তখন কজন মেয়েকে আমরা শেফ কিংবা হোটেলের ম্যানেজার হিসেবে দেখতে পাই? কারণ, শ্রমে নারীকে নিয়োজিত করা যেতেই পারে, আসল লড়াইটা আদৌ শারীরিক সক্ষমতা বনাম অপারঙ্গমতার নয়। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই কাজের বিনিময়ে মজুরির ব্যবস্থা চালু হল, তৎক্ষণাৎ তা হয়ে উঠছে পুরুষের একচেটিয়া।
অন্নসংস্থান এবং পরিবার প্রতিপালন আসলে পুরুষের কাজ, ফলে অর্থের বিনিময়ে শ্রমের চাহিদায় পুরুষের অধিকার বেশি, এইরকম একটা ভ্রান্ত ধারণা পুঁজিপতিদের মাথাতেও ঢুকে বসে আছে, চাকরি দেওয়ার ভার আদতে যাঁদের ওপরে। বিশ্বজোড়া মজুরি বৈষম্যের ২০২২ সালের রিপোর্ট বলছে, ভারতে মেয়েদের আয় পুরুষদের তুলনায় পুরোপুরি ২৩ শতাংশও নয়। ২০২২ সালের জুলাই থেকে শুরু করে ২০২৩-এর জুন পর্যন্ত বেতনভুক সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে, ভারতীয় পুরুষের গড় মাসিক আয় যেখানে ২০,৬৬৬ টাকা; সেখানে একই বা অনুরূপ শ্রমের বিনিময়ে মেয়েদের আয় ১৫,৭২২ টাকা। এখানে ‘অনুরূপ’ কথাটার বিশেষ গুরুত্ব আছে। কারণ বৈষম্যের ক্ষেত্রটা এতটাই বিরাট যে, একইরকম পারঙ্গমতা, প্রশিক্ষণ, কায়িক শ্রমের ক্ষমতা এবং মেধার প্রমাণ রাখার পরেও বহু সময়েই কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের কাজকে কিছু নির্দিষ্ট ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে রাখা হয়।
বিশেষত, কারখানা, খনি, স্থাপত্যনির্মাণশিল্প, বস্ত্রবয়ন প্রভৃতি যন্ত্রনির্ভর কর্মক্ষেত্রগুলোতে গায়ের জোরে যেসব যন্ত্র চালাতে হয়, সেখানে মেয়েদের অংশগ্রহণের মাত্রা লক্ষণীয়রকমের কম। শুধু ‘গায়ের জোর’ যে কেন এখানে বিভেদের আসল মাপকাঠি নয়, সেকথা আগেই বলেছি। বহু ক্ষেত্রে মেয়েদের যেসব কাজ দেওয়া হয়, তার পরিশ্রমটা তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র চালানোর অধিকার পুরুষের। বেশি দূরে যেতে হবে না, এই আঠেরো শতকের আগেই, চরকায় সুতো কাটার কাজ সাধারণত করতেন মহিলারাই, কিন্তু সুতোকলে মেশিন চালাতে শুরু করল পুরুষ শ্রমিকের দল। সেখানে মেয়েদের ভূমিকা ছিল বড়োজোর রঙের চৌবাচ্চায় সুতো চোবানো, শুকোনো, গাঁটরি বাঁধা বা সুতোর আঁশ ছাড়ানোর মতো গায়েগতরে খাটার কাজ। যদি বা মেয়েরা যন্ত্রে হাতও দেয়, সেখানেও রয়েছে তর-তম ভাগ। যে যন্ত্র যত ‘প্রিমিটিভ’, যার ‘অপারেশন’ বা কর্মপদ্ধতি যত বেশি ‘ম্যানুয়াল’ বা মানবিক শ্রমনির্ভর, তার ওপরে বরং কিছুটা হলেও মেয়েদের জোর বেশি। যেমন কাপড়ের কারখানায় সেলাইয়ের হাতমেশিন অথবা পায়ে ঘোরানো মেশিন চালিয়ে হেম করবে মেয়েরা, কিন্তু জিপার, ভেলক্রো কিংবা হুক লাগানোর মেশিন চালাচ্ছে ছেলেরা। মেয়েদের কাজকে ‘মেয়েলি কাজ’ বলে নাক সিঁটকোনোর এই মূলগত প্রবণতার ভিত্তিতেই আদতে শুরু হয় শ্রম বাবদ পুরুষের তুলনায় নারীশ্রমিকের অবমূল্যায়ন। এই প্রসঙ্গে চটকলের কাজের কথাটা আলাদা করে একবার মনে করিয়ে দিতে চাইব। কারণ, সুতো জড়ানোর কাজটা আগে শুধু মেয়েরাই করত বলে, এই ওয়ার্প ওয়াইন্ডিং বিভাগকে বলা হত ‘মাগীকল’।
বেসরকারি এবং অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। আয়ের বৈষম্য সেখানে মাত্রাছাড়া, কারণ কর্তৃপক্ষ তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য কারোর কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। এই মুহূর্তে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নয়নমণি যে টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রি, সেখানেই মেয়েদের আয় পুরুষের তুলনায় ২৮-৩০ শতাংশ কম। চাকরির একেবারে গোড়ার দিকে, যখন পদাধিকারের জোরে ঊর্ধ্বতন স্তরের সঙ্গে লড়াই বা তর্কাতর্কি করার ক্ষমতা বিশেষ আসে না, এই শোষণের একেবারে কাগুজে প্রয়োগ শুরু হয় সেইখান থেকেই। ভারতের মতো বেকারসমস্যাপীড়িত দেশে চাকরি পাওয়াটাই যেখানে মুশকিল, সেখানে এই প্রাথমিক আপত্তিজনক শর্ত খানিক চোখকান বুজে মেনে নিয়েই কাজে ঢুকে পড়ছে মেয়েরা। সমানাধিকার দাবি করার মতো জমি পায়ের তলায় যত দিনে শক্ত হচ্ছে, ততদিনে তারই সইসাবুদ করা সেই শর্ত মেনে চলার শর্ত হয়ে দাঁড়ায় গলার কাঁটা। রিপোর্ট বলছে, এই মজুরি বৈষম্যের সবচেয়ে বেশি প্রতিফলন তাই দেখা যায় জুনিয়র ম্যানেজমেন্ট-এর ক্ষেত্রে, প্রায় ৮৮ শতাংশ। আইন তুলে প্রশ্ন যে কখনও ওঠেনি, তা নয়। সেখানে এইসব কর্পোরেট কিংবা ব্যক্তিনির্ভর ইন্ডাস্ট্রির নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য শুনলে হাঁ হয়ে যেতে হয়। তাঁদের যুক্তি, বিবাহিতা মেয়েদের সাংসারিক দায় বেশি, ফলে কর্মক্ষেত্রে তাঁদের উৎপাদনশীলতা কম। সন্তানধারণের সময় মাতৃত্বকালীন ছুটিও না দিলে চলে না, উপরন্তু সেই সন্তানের দেখাশোনা বাবদ যে বাড়তি সময়ের প্রয়োজন, সেইটুকুও মহিলা কর্মীরা তাঁদের কাজের সময় থেকেই ছেঁটে বের করে নেন। তাই মহিলা কর্মী বা শ্রমিক কর্মক্ষেত্রের বোঝা! এমনকী, আইনি নিয়মমাফিক ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিও বহু কর্মক্ষেত্রেই স্বপ্নমাত্র। প্রসবপূর্ব তত্ত্বাবধান, প্রসব ও ক্ষেত্রবিশেষে সার্জারি এবং প্রসবপরবর্তী ব্যাপক শারীরিক ধকলের ভার সামলানোর জন্য বরাদ্দ মাত্র তিন মাস।
আইনি ব্যবস্থাপনার কড়াকড়িতে সরকারি ক্ষেত্রগুলোতে এখন খোলাখুলি বিভাজনের করাত চালানো যায় না ঠিকই, কিন্তু সেখানেও নানা চোখরাঙানি আর বাঁকা মন্তব্যের জের সইতে হয় মেয়েদের। ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’ নামে যে বিশেষ ব্যবস্থা আজকাল হয়েছে, সেখানে সন্তানের আঠেরো বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সন্তানপিছু মোট দু-বছরের, এক এক দফায় অন্ততপক্ষে ১৫ দিন, ছুটি কর্মরতা মাকে মঞ্জুর করা হয়। এই ছুটি পাওয়া আর না পাওয়া নিয়ে পুরুষকর্মীদের ঈর্ষা বনাম মহিলাকর্মীদের হকের পাওনা সংক্রান্ত গোলমালের নজির লাগামছাড়া। এখন পুরুষদেরও একইরকম পিতৃত্বকালীন ছুটির দাবি উঠেছে। অত্যন্ত সংগত দাবি, নিঃসন্দেহে। অন্তত শিশুপালন যে বাধ্যত মায়েরই কাজ, আইন করে সেই কথাটা চোখে আঙুল দিয়ে সরকার বুঝিয়ে ছেড়েছিল। তার একটা প্রত্যুত্তর তো তৈরিই হয় এতে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, কর্মক্ষেত্রে ছুটি মেয়েদের দেওয়ার দরকারটা পড়ছে, কারণ মেয়েরাই শিশুপালনের জন্য কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নিতেন, সে ছুটি তাঁদের প্রয়োজন ছিল, এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে ছুটির দিনের পারিশ্রমিক না পাওয়ার ক্ষতিটুকু স্বীকার করার বিনিময়েও। তখন কিন্তু এই শিশুপালক পিতারা কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সমঝোতা করেননি। ঘর-সংসার-বাচ্চাকাচ্চা-গেরস্থালি প্রভৃতি মানবিক সম্পদের দিকে যে মেয়েরা অকারণেই বেশি বিনিয়োগ করে, কর্মক্ষেত্রে তাতে ক্ষতিই হয়, সে নিয়ে বড়ো বড়ো ফিরিস্তি নামিয়েছেন তাঁরা, নিজেদের ‘বেটার ক্যান্ডিডেট’ হিসেবে কাজের বাজারে দাঁড় করানোর আশায়। কিন্তু আজ, ছুটির সঙ্গে যখনই আর্থিক মাত্রা জুড়ে যাচ্ছে, ‘সবেতন’ সেই কর্মবিরতির জন্য তাঁদের দাবিদাওয়ারও অন্ত নেই!
অথচ সমীক্ষা বলছে, একজন পুরুষ নিজের সময়কে বাজারে বিনিয়োগযোগ্য অর্থকরী শ্রম এবং বিশ্রাম বাবদ পরিষ্কার দুই ভাগে ভাগ করতে পারে। কিন্তু, এর বাইরেও মেয়েদের আরও একটি তৃতীয় দায়বদ্ধতা গৃহশ্রম, যা পারিশ্রমিকহীন এবং মেয়েদের মোট শ্রমের ৬৬ শতাংশ বরাদ্দ হয় এই মজুরিবিহীন অপরিমাপযোগ্য গার্হস্থ্য কাজের পিছনেই। এই কাজের সুফল ভোগ করবে যারা, তারাই কিন্তু এই শ্রমের বাজারে এই কাজকে কাঠগড়ায় তুলবে, তুলছেও। আমাদের অনেকেরই ধারণা, পরিস্থিতি নাকি দ্রুত বদলাচ্ছে। তা কতটা ত্বরণ রয়েছে এই পরিবর্তনের গতিতে, তার একটু নমুনা আপনাদের দেখাই?
ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইন্ডেক্স ২০২৪’ অনুসারে, যে গতিতে বৈষম্য কমছে, তা অব্যাহত থাকলে, এখনও অন্তত আরও ১৩৪ বছর লেগে যাবে সাম্যে পৌঁছোতে। ততদিন পর্যন্ত মেয়েদের শ্রম ‘ভূতের বেগার’ হয়েই থাকবে। তার ছায়া আছে, কায়া নেই। কাজের ফল আছে, মজুরি নেই। ডানাভাঙা এই অর্থনীতি নিয়ে খুঁড়িয়ে চলার দিন আদৌ শেষ হয় কবে, সেটাই চাওয়ার।