মা এসেছেন বাপের বাড়ি। আর সঙ্গে তাঁর সন্তানসন্ততিরা থাকবেন না! তাই কি কখনও হয়? অতএব তাঁরাও আসেন। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ সমেত মা আসেন বাপের বাড়িতে। এখন কথা হল, সত্যিই কি এঁরা মা দুর্গার সন্তান? নাকি এঁদের উৎপত্তির অন্য কোনও ব্যাখ্যা আছে? আসুন শুনে নিই।
ছেলেপুলে নিয়ে মা তো চলে আসেন বাপের বাড়ি। শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজোর যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, আমরা বাঙালিরা এভাবেই ভাবতে ভালবাসি। মায়ের আগমনে চারিদিকে আলোয় আলোময়। কিন্তু এই যাঁদের আমরা মায়ের ছেলেমেয়ে বলি, অর্থাৎ লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশ- তাঁরা এলেন কোথা থেকে?
একটু পিছু ফিরে তাকালে অবশ্য আমরা ঠিক করে চিনে নিতে পারব তাঁদের। বৈদিক সাহিত্য মন্থন করেছেন যাঁরা, তাঁরা জানান, বৈদিক যুগে যে যজ্ঞবেদী ছিল তার নাম দক্ষ-তনা। রাজা দক্ষ যেই হোন না কেন, তিনি যে বহু যজ্ঞ করেছিলেন তা বেশ বুঝতে পারা যায়। এই দক্ষ-তনা শব্দবন্ধটিই কালক্রমে হয়ে দাঁড়াল দক্ষতনয়া। এদিকে যজ্ঞবেদীতে বা যজ্ঞকুণ্ডে থাকে অগ্নি। বেদী আর অগ্নি যেন পরিস্পরকে আলিঙ্গন করেই আছে। মনে করা হয়, এই অগ্নিই হলেন স্বয়ং মহাদেব। কেননা মহাদেবকে বলা হয় রুদ্র। এই রুদ্র শব্দে অগ্নি ও মহাদেব- দুজনকেই বোঝানো হয়। অর্থাৎ এইদিক থেকে দেখতে গেলে, অগ্নিরূপে মহাদেব আর দক্ষতনয়া থাকলেন পাশাপাশি। এই বাস্তবতাই ক্রমে রূপ পেয়েছে শিব ও দুর্গার বিয়ের গল্পে।
আরও শুনুন: সিংহরাজের কেশর জোড়া আর হাওয়ায় ভাসা পুজোর ছুটি
এখন বেদী কীভাবে দেবী দুর্গায় রূপান্তরিত হল, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রাজ্ঞজনেরা। বলা হয়, কোনও একটা সময় এসেছিল, যখন বেদীতে আর আগুন জ্বালানো হত না। ঋষিরা সযত্নে বেদী রক্ষা করে তার চারপাশে ধ্যানে নিমগ্ন হতেন। এরপর যখন পরিস্থিতির বদল হল, তখনও ঋষিরা আগুন না জ্বালিয়ে একটি মূর্তি নির্মাণ করলেন। এই মূর্তিকেই তাঁরা অগ্নি ভাবতেন, এবং মনে করতেন, তাঁদের হব্য এই মূর্তি দেবতার কাছে পৌঁছে দেবেন। এই মূর্তির তাই নাম হল হব্যবাহিনী। যত সময় গড়িয়েছে এই মূর্তিই ক্রমে দশভুজা দেবীর রূপ নিয়েছে। যজ্ঞবেদীর দশ দিক এই রূপকল্পে দেবীর দশ হাত হয়ে ধরা দিয়েছে। যেমন বেদী আর অগ্নি অচ্ছেদ্য, তেমনই এক্ষেত্রেও অগ্নি আর দুর্গা অভিন্ন হিসেবেই ধরা দিলেন। বৈদিক যুগের শেষের দিকে দক্ষতনা হল উমা, উমা থেকে অম্বিকা হয়েই দুর্গার উৎপত্তি।
এখন এই কুণ্ডে আরও কয়েকজন দেবতার ছোট ছোট মূর্তি রাখা থাকত। তাঁরা কারা? একজন যোদ্ধা, যিনি কুণ্ডকে রক্ষা করতেন। অন্যজন যজ্ঞের সূচনা করে দিতেন, তাঁর চার হাত। একজন ছিলেন যজ্ঞের জ্ঞানদাত্রী, অপরজন যজ্ঞের জন্য অর্থাগমের ব্যবস্থা করতেন। আমরা বুঝতে এই চার দেবমূর্তিই কালক্রমে কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী এবং লক্ষ্মীর রূপ পেয়েছে। অর্থাৎ, হব্যবাহিনীর এই মূর্তি এবং তাঁর চারপাশে থাকা দেবমূর্তির ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, সেই বৈদিক যুগের যজ্ঞ-বেদীর যে স্বরূপ, তাই-ই দশভুজা দেবী এবং তাঁর সন্তান-সন্ততি হিসেবে ধরা দিয়েছে বর্তমানে।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: পূজার আয়োজন করতেই লটারির খেলা, ধনী বাড়ি থেকে বারোয়ারি মণ্ডপে আসেন দুর্গা
বাকি থাকল অসুর। ঋগ্বেদ থেকে এ-ও জানা যায় যে, এই যজ্ঞের অগ্নিতে অসুরদেরও বলিদান হত। এবার তাহলে পুরোটাই মিলে গেল। অর্থাৎ, আজ আমরা যা যা দেখি, দেবী দুর্গাকে ঘিরে যা যা কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে তার মূল যে সেই যজ্ঞবেদীতেই, এই কথাই মনে করিয়ে দেন প্রাজ্ঞজনেরা। তো এই হল দেবী দুর্গা আর তাঁর ছেলেমেয়েদের আজকের রূপের গোড়ার কথা। তারপর কত না সময়ের স্রোত বয়ে গিয়েছে। বাঙালি এই উৎসবকে তার মনের মাধুরী মিশিয়ে আপন করে নিয়েছে। আর তাই, বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো হল ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মা দুগগার বাপের বাড়ি আসা। দিকে দিকে বেজে ওঠে আগমনী গান। আর সে গান বলে, এবার আমার উমা এলে আর উমাকে ফেরাব না…। না আমরা কেউই উমাকে ফেরাতে চাই না। তাইতো হাতের পাঁচ যে-কটাদিন তাঁকে পাওয়া যায়, আনন্দের সানাই বেজে ওঠে প্রকৃতিতে, আমাদের মনেও।