নররক্তে তুষ্ট হন দেবী। এমনই মনে করেন ভক্তরা। তাই প্রতি বছর দুর্গপুজোর সময় ব্যবস্থা হয় নরবলির। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সে নিয়মে বদল হয়নি। কিন্তু এমনটা তো আইনত অপরাধ। তাহলে কোন উপায়ে শতাব্দী প্রাচীন নিয়ম পালন করেন ভক্তরা? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
লুঠ করতে যাওয়ার আগে দেবীর পুজো করতেন ডাকাতরা। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বিখ্যাত সব ডাকাত কালী মন্দির আজও রয়েছে। শোনা যায়, সেইসব দেবী মূর্তির সামনে নরবলি দিতেন ডাকাতরা। তবে এমন নিয়ম চালু ছিল দুর্গাপুজোতেও। ডাকাতরা নয়, সাধারণ মানুষই বলি দিতেন নিরীহ কাউকে। এতদিনেও সে নিয়ম বদলায়নি।
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। ওড়িশার খুরদা জেলার বানপুরে এখনও নরবলির চল রয়েছে। সেখানকার বিখ্যাত ভগবতী মন্দিরে প্রতি বছর বলির ব্যবস্থা করা হয়। তবে রক্ত মাংসের মানুষ হত্যা করা হয় না। পুরোটাই হয় প্রতীকী আকারে। নিয়ম রক্ষার্থে মানুষের প্রতিকৃতি গড়ে তা বলি দেওয়া হয় দেবীর সামনে। তবে এমন ভাবেই সবটা করা হয়, যে মনে হবে না বিষয়টা সাজানো। আসলে বানপুরের এই মন্দির বেশ প্রাচীন। তায় জনপ্রিয়ও বটে। তবে মূর্তি বা পুজোর জন্য নয়, এই মন্দিরের যাবতীয় জনপ্রিয়তা এই বলির নিয়মকে কেন্দ্র করেই। একসময় নরবলি দেখার জন্য ভিড় করতেন আশেপাশের গ্রামের মানুষ। তাঁদের কাছে এই হত্যায় কোনও অপরাধ ছিল না। বরং দেবীর কাছে একজন কাউকে বলি দিয়ে আগামী একবছর নিজেদের সবরকম বিপদ থেকে সুরক্ষিত রাখতেন গ্রামবাসী। ব্রিটিস আমলে এই নরবলি বন্ধ হয়। আইন করে বলি নিষিদ্ধ করেন সাহেবরা। তবে পশুবলি চলত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সে নিয়ম বদলায়নি। দেশের অন্যান্য অনেক মন্দিরের মতো এখানেও একাধিক পশু বলির ব্যবস্থা হত পুজোর সময়। তবে ২০০৯ সালে ওড়িশার হাই কোর্ট তাতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে গ্রামের অনেকেরই সায় ছিল না। তাই শুরু হয় প্রতীকী বলিদানের নিয়ম। নতুন করে রক্তহীন বলি আরম্ভ হয়। এইভাবে চালু হয় নরবলিও। নির্দিষ্ট একজন কাউকে সাজিয়ে দেবীর সামনে বলি দেওয়া হয়।
ব্যাপারটা ঠিক কেমন?
একসময় এই গ্রামের জানা পরিবারের সদস্যদের বলি দেওয়া হত। প্রতিবছর পরিবারের একজন করে পুরুষ স্বেচ্ছায় মায়ের পায়ে জীবন উতসর্গ করতেন। অবশ্য অনেকে বলেন স্বেচ্ছায় এই কাজ করতেন না কেউই। বরং বাধ্য হতেন। যাইহোক সেসব অতীতের কথা। বর্তমানে কাউকে হত্যা করা হয় না। তবে পুরনো নিয়ম মেনে এখনও জানা পরিবারের সদস্যরাই প্রতীকী বলিতে অংশ নেন। বিগত কয়েক বছর বলিতে অংশ নিচ্ছেন রবীন্দ্র কুমার জানা। স্থানীয় অনেকে তাঁকে ‘বলি’ জানা বলেও ডাকেন। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বলি সম্পন্ন হয়। সেও ভারি মজার। পুজোর প্রথম দিন রবীন্দ্র জানা গ্রাম ছেড়ে দূরের এক মন্দিরে চলে যান। সেখান থেকে বিরাট শোভাযাত্রা করে তাঁকে গ্রামে আনা হয়। বলি হয় শেষ দিনে। সকাল থেকে চারিদিকে সাজো সাজো রব। বিশেষভাবে সাজিয়ে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় রবীন্দ্রকে। সেখানে তাঁর গলায় মালা পরানো হয়। এই মালা নাকি মন্ত্রপূত। এবং তা গলায় পরলেই অজ্ঞান হয়ে যান রবীন্দ্র। তারপর কী হয় সেসব মনে থাকে না রবীন্দ্রর। আসলে, এই সময়টা সকলে মনে করেন রবীন্দ্র মারা গিয়েছেন। দেবীর সামনে তাঁর এই অবস্থায় পৌঁছে যাওয়াই বলি হিসেবে ধরা নেনে সকলে। ঢাকের বাদ্যি বেজে ওঠে। পরিবেশ এমন হয়ে ওঠে মনে হবে বলি সম্পন্ন হয়েছে। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় অচেতন দেহ। জ্ঞান ফিরলে উঠে যান রবীন্দ্র। আপাতভাবে দেখলে মনে হবে সবটাই নাটক। তবে গ্রামের মানুষ যেভাবে ভক্তি সহকারে গোটা বিষয়টা পালন করেন তা উপেক্ষা করার উপায় নেই।