অষ্টমীর দিন ভোর না হতেই বেলুড় মঠের দরজায় ভিড় জমান ভক্তরা। কুমারী পূজার সাক্ষী হতে। দেবী দুর্গার প্রতীক হিসেবেই একটি কুমারী কন্যাকে সেদিন পুজো করা হয় বেলুড় মঠে। জানেন কি, বেলুড় মঠে প্রথম কাকে দুর্গা বলে পুজো করা হয়েছিল?
দুর্গাপূজার মহাষ্টমী বললেই চোখে ভেসে ওঠে সালংকারা একটি শিশুকন্যার ছবি। কুমারী পূজা। আর কুমারী পূজার নামে বাঙালির স্বভাবতই মনে পড়ে বেলুড় মঠের কথা। যেখানে দেবী দুর্গা হিসেবে পুজো করা হয় একটি কুমারী কন্যাকে। অষ্টমীর দিন ভোর না হতেই টিভির পর্দায় চোখ রাখেন ভক্তরা, বেলুড় মঠের এই সাড়ম্বর পূজার্চনার সাক্ষী হতে। আর যাঁরা স্বচক্ষে এই পূজা দেখতে পান, নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করেন তাঁরা। এই পূজার জন্য বিভিন্ন লক্ষণ দেখে নির্বাচন করা হয় কোনও শিশুকন্যাকে। সাত-আট বছর বয়সও পেরোয়নি, সাধারণত এমন কোনও মেয়েকেই বেছে নেওয়া হয়। কিন্তু জানেন কি, মঠে প্রথম যাঁকে দুর্গা হিসেবে পুজো করা হয়েছিল, তিনি কোনও কিশোরী ছিলেন না। বরং বৃদ্ধাই বলা চলে তাঁকে। জানেন কি, কে ছিলেন তিনি?
আরও শুনুন:
ব্যবসায় মন্দা, দুর্গাপুজো করে নাকি বিপুল লাভের মুখ দেখেছিলেন এক ইংরেজ সাহেব
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহান্ত হয়েছে ততদিনে। তাঁর সরাসরি দীক্ষিত বারোজন মন্ত্রশিষ্য বেছে নিয়েছেন সন্ন্যাসীর জীবন। সুতরাং প্রয়োজন পড়ল একটি মঠ স্থাপনের। যা তাঁদের এবং তাঁদের অনুগামী আরও নতুন সন্ন্যাসীদের আশ্রয় দেবে। যা তাঁদের কর্মসাধনার সুযোগ দেবে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বাণী প্রচারের কেন্দ্র হবে সেই মঠ। তিল তিল করে গড়ে উঠল তাঁদের নেতা, স্বামী বিবেকানন্দের কল্পনায় দেখা সেই বেলুড় মঠ। আর বিবেকানন্দ যেমন সব কাজের পরিকল্পনা করেন, তেমন করেই একদিন বিরাট বড় একটা পরিকল্পনা করে ফেললেন তিনি। প্রস্তাব দিলেন মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার আয়োজন করা হোক মঠে। সন্ন্যাসীরা সকল রিপুকে জয় করার লক্ষ্যেই চলেছেন, সুতরাং রিপুস্বরূপ অসুরকে যিনি বধ করেন সেই দেবী দুর্গার আরাধনা করার প্রস্তাবে তাঁদের অসম্মত হওয়ারও কারণ ছিল না। ১৯০১ সালে বেলুড় মঠে প্রথমবার দুর্গাপূজার সূচনা করলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
আরও শুনুন:
অষ্টমীর রাতে আয়োজন, নবমীতে পুজো শুরু… ২৫৩ বছরে পা বেহালার সোনার দুর্গার
কিন্তু দেখা গেল দুর্গাপুজো করার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে একটি। সন্ন্যাসীরা সে পূজায় পৌরোহিত্য করতে পারবেন, কিন্তু পূজার সংকল্প তো তাঁদের নামে হতে পারে না। সবাই যে ঘরছাড়া সন্ন্যাসী। তাহলে কী করা যায়? উপায় বের করলেন সেই বিবেকানন্দই। তাঁরা নাহয় সন্ন্যাসী, কিন্তু মঠের সঙ্গে তো এমন একজন জড়িয়ে আছেন যিনি সন্ন্যাস নেননি। শ্রীমা সারদা দেবী। যিনি তাঁদের সকলের মাতৃস্বরূপা। মায়ের পুজোয় মায়ের নামে সংকল্প হবে, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? সকলে সমস্বরে সায় দিলেন বিবেকানন্দের কথায়। সারদা দেবীও কোনও আপত্তি করলেন না এ প্রস্তাবে। সুতরাং পুজোয় আর কোনও বাধা রইল না।
কিন্তু দুর্গাপুজো শুরুর আগে আরেকটি অভিনব কাজ করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর মনে হল, পূজার আসনে রাখা মৃন্ময়ী প্রতিমাকে আগমন জানাতে যেমন বলা হয়, ‘ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’, সেই মাতৃরূপটিই তো সশরীরে উপস্থিত তাঁদের সামনে। তাঁদের সকলের মা। সারদা দেবীর মুখ আর দুর্গাপ্রতিমার মুখ যেন মিলে গেল তাঁর চোখে। ঠিক করলেন, এই মাকে আক্ষরিক অর্থেই পুজো করবেন তিনি। সেই ভাবনামতোই অষ্টমীতে ১০৮টি পদ্মফুল নিবেদন করে সারদা দেবীকে পূজা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। মৃন্ময়ী দেবীর সঙ্গে পূজা হয়েছিল তাঁর চোখে দেখা জীবন্ত দুর্গারও।