বেতারে মহিষাসুরমর্দিনী। বিশ্বের ব্রডকাস্টিং ইতিহাসে একে বিরলতম ঘটনা বলা চলে। কারণ, এ হল এমন এক অনুষ্ঠান, যার সঙ্গে একটা গোটা জাতির আবেগ, ধর্মবিশ্বাস, হাসি, আনন্দ সবকিছু জড়িয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রচার জগতে এমন অনুষ্ঠানের সংখ্যাও খুবই কম, যা এতদিন ধরে একইভাবে নিজের মান বজায় রেখেছে। হয়ে উঠেছে বাঙালির চিরন্তন অভ্যাস। আসুন শুনে নিই, মহালয়ার ভোরের স্মৃতিচারণ।
‘মহালয়া’ কোনও উৎসব নয়। এমনকি শাস্ত্রমতে একে শুভও বলা চলে না। কিন্তু বাঙালি এই দিনটাকে কোনও দিনই এত শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বেঁধে রাখেনি। যার অন্যতম কারণ রেডিওর এক অনুষ্ঠান। ডিজিটাল যুগে রেডিওকে যতই দূরে ঠেলা হোক, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে হ্যাঁ, আদ্যিকালের ট্রানজিস্টার ছেড়ে এখন হয়তো তার জায়গা হয়েছে মুঠোফোনে। অপেক্ষার অবকাশও ফুরিয়েছে। চাইলেই বছরের যে কোনও সময়, যে কোনও জায়গায় বেজে উঠতে পারে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর…’। কিন্তু তাতে কী! বাঙালির ‘মহালয়া’ শোনার অভ্যাস তো আর যায়নি।
একটা অনুষ্ঠান কোন মেধাগত উচ্চতায় পৌঁছলে, সামগ্রিক ভাবে একটি জাতির পার্বণের সঙ্গে মিশে যায় যায়, তা সহজেই অনুমেয়। আর এ তো কয়েকবছরের ঘটনা নয়। দীর্ঘ ৯১ বছর ধরে বাঙালির চিরন্তন অভ্যাস। কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তবু দুর্গাপুজোর জেল্লা বরাবরই আলাদা। কিন্তু আলাদা বললেই তো আর আলাদা হয় না। কিছু একটা বিশেষত্ব থাকতে হবে। প্রথমত এই উৎসব চার দিনের। কিন্তু তাতেও কি আলাদা ট্যাগ বসে? তার জন্য কিছু একটা বিশেষ হতে হয়। আর বিশেষ কিছু করার ভাবনা থেকেই বেতারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সম্প্রচারের ভাবনা এল এমনটা বলা চলে। ১৯৩০ সালে কেন্দ্র সরকারের আওতায় এল বেতার। তারপর থেকেই নতুনভাবে শ্রোতাকে আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভাবনা শুরু। তারপরের দু-বছর রেডিওর অনুষ্ঠান নিয়ে রীতিমতো এক্সপেরিমেন্ট চলেছিল। আর সেই আবহেই বাণীকুমার প্রস্তাব দিলেন, দেবী দুর্গার মর্তে আগমন ঘিরে যদি একটা সঙ্গীতবহুল অনুষ্ঠান করা যায়। এ যে একেবারে নতুন কিছু তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তারও আগে এইধরনের এক অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছে বাসন্তী পুজোর প্রাক্কালে। সেই অনুষ্ঠানেও দেবীবন্দনা, স্তোত্রপাঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আগমনি গান শুনেছিল রেডিওর শ্রোতারা। এবার বাণীকুমারের পরিচালনায় শুরু হল শারদীয়া আগেও এক আগমনি অনুষ্ঠান। ১৯৩২ সালে সেই শুরু। আজও স্বমহিমায় বিরাজমান মহিষাসুরমর্দিনী। তখন অবশ্য এই অনুষ্ঠান মহালয়ার দিন হত না। শাস্ত্রমতে দেবীর বোধন হয় ষষ্ঠীর দিনে। প্রথমে সেইদিনেই সম্প্রচারিত হত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। পরে ১৯৩৬ সাল থেকে সম্প্রচার শুরু হয় মহালয়ার দিনেই। এখনও সেই রীতি বদলায়নি। তবে ‘আকাশবাণী’-র প্রযোজনায় এই অনুষ্ঠানে বহু রদবদল হয়েছে। বর্তমানে আমরা যে রেকর্ডিংটি শুনতে পাই, তার নেপথ্যে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের মতো ব্যক্তিত্বরা। এই একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এঁরা বাঙালির কাছে চির অমর হয়ে রয়েছেন। তবে তা হওয়ার জন্য কম ঝড় সহ্য করতে হয়নি। কায়স্থ হয়ে কীভাবে চণ্ডীপাঠ করবেন বীরেন ভদ্র, উঠেছিল এই প্রশ্ন। পালটা কড়া জবাব দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন বাণীকুমার। উলটে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে মুসলিম যন্ত্রশিল্পী রেখেছিলেন তিনি।
সেকালে অনুষ্ঠানটির লাইভ ব্রডকাস্ট হত। অর্থাৎ মহালয়ার ভোরেই সবাই একত্রিত হয়ে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠিত করবেন। তার জন্য রিহার্সাল হত দেখার মতো। যতই নামী শিল্পী হন, রিহার্সালের নিয়ম ছিল সকলের জন্য সমান। এমনকি পঞ্চাশের হেমন্ত মুখুজ্জেকেও রেয়াত করেননি পরিচালক। তা না হলে কি আর এই মাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব! তবে কালের গভীরে সেই নিষ্ঠা হারিয়েছে অনেকটাই। সেকালের স্মৃতিচারণায় শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য বলছেন, ব্রাহ্মমুহূর্তে, প্রদোষলগ্নে জীবনের সুর যে কত উচ্চগ্রামে বাঁধা যায়— তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহালয়া। এমন উঁচুদরের সিম্ফনি বাঙালি আর ক’টা সৃষ্টি করতে পেরেছে! এমনই কোনও এক মহালয়ার ভোর সম্পর্কে তিনি বলছেন, “চতুর্দিকে তখনও অন্ধকার। মা ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। কাল ভোরে মহালয়া শুনব— এই উত্তেজনায় রাত্রে ভালো ঘুমও হত না। তখন তো ঘরে ঘরে ট্রানজিস্টার রেডিওর এমন চল ছিল না। বাল্ব লাগানো, এরিয়াল ঝোলানো ঢাউস সব রেডিও। আমাদের সামনের বাড়ির এক ভদ্রলোকের রেডিওর দোকান ছিল। তিনি মহালয়ার আগের দিন, দোকান থেকে দুটো রেডিও নিয়ে এসে নিজের বাড়ির বসার ঘরে গুছিয়ে রাখতেন। আমরা সবাই এসে জুটতাম। স্বপ্নের মহালয়া শুরু হত।”
বলা বাহুল্য, এই অপেক্ষা এখনও ফিকে হয়ে যায়নি অনেকের কাছেই। মহালয়ার আগের রাতে ঠিকমতো ঘুম না আসা। ভোর হওয়ার অপেক্ষা। আর সেইসঙ্গে চিরন্তন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।