শরৎকাল জুড়ে পুজোর গল্প। গল্পের এই মরশুমে শুনুন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র নিবেদনে নতুন গল্প। আজকের গল্প, সম্বিত বসু-র ‘হারানো বিষয়ে দু-একটা কথা‘। পড়ে শোনাচ্ছেন, সরোজ দরবার।
শুনুন গল্প: ‘হারানো বিষয়ে দু-একটা কথা’।
১. গল্পটা যেখান থেকে শুরু, সে অংশটা খুঁজে পাচ্ছি না।
২. গল্পটা মাঝে মাঝেও হারিয়ে গিয়েছে।
৩. এমন কোনও আঠা আবিষ্কৃত হয়নি, যা গল্পগুলো জুড়ে দিতে পারে। এমন কোনও পুলিশ স্টেশন নেই, যে খুঁজে এনে দিতে অনুপস্থিত শব্দগুলো। আছেন একজন, এক নামকরা দরজি, পারলেও পারতেন, কিন্তু তাঁর নাম-ঠিকানা আমি হারিয়ে ফেলেছি।
৪. সেদিন রাতে, আলো নেভানোর পরও, ছায়াটি সঙ্গে থেকে গেল। সেদিন সকালে, শুধু ছায়াটিই জেগে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল, ভুল করে। শরীর ঘুম থেকে উঠল যখন, ছায়াকে দেখতে পেল না। এদিকে সেই ছায়া, এক গাছের তলায় শরীরের জন্য অপেক্ষা করছে তো করছেই। কে হারিয়ে যাবে শেষমেশ? ছায়া না কায়া? এর উত্তর হবে: গাছ। তবে, সেদিন একটা গাছ, কেটে নেওয়ার পরও, গাছের ছায়াটি দিব্যি থেকে গেল।
৫. খুব মনখারাপ থাকলে, খুব ভোরবেলা, খুব জল খেয়ে ও মূত্রত্যাগ না করে, কাছের রেল স্টেশনে চলে যান। প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ান। ট্রেন থামলেই দৌড়ে ধরুন সকালের প্রথম ট্যাক্সি (মনে রাখবেন, এই সময় তাড়াহুড়োই আপনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে) একটু যেতে আপনার হঠাৎ মনে পড়বে: ‘আমার লাগেজ!’ স্টেশনে ফিরুন। যে কোনও ট্রেন ঘেঁটে দেখবেন আপনার লাগেজটি সত্যিই বেপাত্তা! ট্যাক্সি ড্রাইভার এরপর স্টেশনে হারানোর নানা গল্প শুরু করবেন। প্রথম থেকে আপনি চাইলেও একা একা তা করতে পারতেন না।
৬. মানুষ নখের ব্যবহারে খুব পটু। নখ কতটা ধারালো তারও মাঝে মাঝে পরীক্ষা প্রয়োজন। আত্মরক্ষার্থে, শত্রুতায়, যৌনতায় নখের ব্যবহার প্রচলিত! দাঁতে আটকে থাকা পেয়ারাবীজ বা মাংসের টুকরো সহজেই নখের কাছে বশ মানে। তবু নেলকাটার কিনতে হয়। নেলকাটার হারিয়েও যায়। হারিয়ে যাওয়া নেলকাটারের পৃথিবীতে দাঁত নখের শত্রু হয়ে ওঠে।
৭. ক্রিকেট খেলতে গিয়ে যে-বাড়ির ছাদে বল হারিয়ে যায় সাময়িক, সে-বাড়ির কেউ সদর দরজা খুলে দিলে, বাড়িটি মুখস্থ থাকে বহুকাল।
৮. সাদা ছাতা। কালো ছাতা। রঙিন ছাতা। যে কোনও ছাতাই আমরা হারিয়ে ফেলি। আমাদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিভেজা দিনের সংখ্যা বেড়ে যায়। আসলে হারানো সম্পর্কে আমরা যতটা সচেতন, ছাতা সম্পর্কে ততটা নই। তাই ছাতা ক্রমাগত হারিয়ে যেতে থাকে। হারানো হারায় না।
৯. হঠাৎ একদিন, সে দাঁড়িয়ে পড়ে বিছানার ওপর, খামোকাই। হাত তুললেই ছাদে হাত ঠেকে যাবে এখন, কিন্তু তার মনে পড়ে গেল ওরই বালকশরীর, ১৯৯৮ সালে ঝুলঝাড়ু দিয়ে ফ্যান ঘোরাতে ভালবাসত সে। মনে করত সেই-ই বিদ্যুৎ। আজ সেই বিদ্যুৎ হারিয়ে গিয়েছে। আজকাল ফ্যানের তিনটে ব্লেডে অকস্মাৎ নিজেকে লেখা তিনটে চিঠি রেখে সে চালিয়ে দেয় ফ্যান। উড়ে এসে এদিক-সেদিক পড়ে সেই চিঠি। কী লেখা সেই তিন চিঠিতে, খুলে পড়ে না কখনও। সেই চিঠি– হারিয়ে যাওয়া এক বালকের, বিদ্যুৎহীন এক যুবকের প্রতি ক্ষোভে।
১০. যে কোনও হারানোই নাকি সিনেমা– কথাটা সে লিখে রেখেছিল! লিখে রেখেছিল এখানে-ওখানে। ডায়েরিতে, খাতায়, বইয়ের প্রথম পাতায়। পরে, সেই লিখে রাখা পাতাগুলো হারিয়ে গিয়েছে, বই হয়েছে হাতফেরতা। কিন্তু মনে থেকে গিয়েছে এই কথাটা। সে এখন বুঝেছে, হারিয়ে যাওয়া জিনিস মনে রেখে দেওয়া– আরও বড় সিনেমা।
১১. ১৯৯৬ সাল। বাড়ি রং হবে। ফোন নাম্বার লেখার জন্য ডায়েরি কিনে আনা হয়েছে বাজার থেকে। দেওয়াল থেকে একে একে বন্ধু, আত্মীয়, গ্যাসের অফিস, ব্যাঙ্ক, অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার ফোন নাম্বার এসে পড়ছে ছোট ডায়েরিতে। শুধু পেনসিলে আঁকা গাছ, ভূত, সাইকেল, সূর্য ও একচালার বাড়ি– চিরকালের মতো হারিয়ে গেল।
১২. রিমোট কনট্রোল হারিয়ে গেলে, মানুষ আরও যন্ত্র হয়ে ওঠে।
১৩. গল্পটা যেখানে শেষ হবে, সেই অংশটা কোনওভাবেই খুঁজে পাচ্ছি না।