এলাকায় উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ, সংখ্যালঘু সকল প্রকার প্রজাদের নিয়ে, ১৬১০ সাল থেকে দুর্গাপুজো শুরু করলেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ভগবতী দেবী। এখন মোট ৮টি শরিকি বাড়িতে পুজো হয় সাবর্ণদের। এ বাড়ির পুজোর বিশেষত্ব হল আমিষ ভোগ। সন্ধিপুজোয় আবার ল্যাটা মাছ পোড়া দেওয়ার নিয়ম রয়েছে বলেও জানা যায়। আর কী কী বিশেষত্ব রয়েছে এই বাড়ির পুজোয়? আসুন শুনে নিই।
জোব চার্নক নন, তাঁরাই ছিলেন কলকাতার আদি মালিক। সেই কোন প্রাচীন কালে নিজেদের ঘরে দেবী দুর্গাকে আহবান করেছিলেন তাঁরা। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। হাতবদল হয়েছে কলকাতার। গ্রামের জায়গায় গজিয়ে উঠেছে একটা আস্ত শহর। আর এখন তো সে তকমা পেয়েছে মহানগরের। তবুও, এত কিছুর মধ্যে অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে একটা ঘটনা। দুর্গাপুজো। চারশো বছর পেরিয়েও পুজোর ধারা জিইয়ে রেখেছে এই বাড়ি।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: প্রথম বাঙালি লাখপতির বাড়ির পুজো কেমন ছিল জানেন?
হচ্ছে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির কথা। যাঁদের আদি বাসস্থান ছিল কনৌজে। পূজার্চনা, বিধিবিধান প্রণয়নের জন্য কনৌজ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণকে এনেছিলেন বাংলার শাসক আদিশূর। সেটা ৯৭৫ সাল। তাঁদের মধ্যে একজন বেদগর্ভ। সাবর্ণ বংশের প্রথম পুরুষ তিনিই। ১৬০০ সালে হালিশহরের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন সাবর্ণরা।
১৬০৮ সালে দেবী দুহাত ভরে আশীর্বাদ করেন সাবর্ণদের। লক্ষ্মীকান্ত রায়কে আটটি পরগণার নিষ্কর জায়গির দান করলেন মানসিংহ। মাগুরা, খাসপুর, ডিহি কলিকাতা, পাইকান, আনোয়ারপুর, আমিরাবাদ, হাতিয়াগড় এবং হাভেলিশহর। তিনি হয়ে উঠলেন বারো ভুঁইয়ার একজন। উপাধি পেলেন চৌধুরী। এরপর, বড়িশায় বসবাস শুরু করেন লক্ষ্মীকান্ত। এলাকায় উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ, সংখ্যালঘু সকল প্রকার প্রজাদের নিয়ে, ১৬১০ সাল থেকে দুর্গাপুজো শুরু করলেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী। দুরদূরান্ত থেকে প্রজারা তাঁদের খেতের ফল, শস্য নিয়ে এসে দেবীকে উৎসর্গ করেন। পুজোর আনন্দে মেতে ওঠেন সকলে।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: অষ্টমীর রাতে আয়োজন, নবমীতে পুজো শুরু… ২৫৩ বছরে পা বেহালার সোনার দুর্গার
একচালা দুর্গাপ্রতিমার পুজো শুরু করেছিলেন সাবর্ণরা। একটিমাত্র চালচিত্রে আঁকা থাকে দশমহাবিদ্যা এবং রাধা-কৃষ্ণের ছবি। তার সামনেই টানা-চৌরি রীতিতে তৈরি হয় প্রতিমা। আশ্চর্য ব্যাপার, প্রতিমার একপাশে থাকেন শ্রীরামচন্দ্র, আর অন্যপাশে মহাদেব। দেবীর সঙ্গে পুজো পান তাঁরাও। নৈবেদ্য সাজানো হয় অসুর, পশু এবং অপদেবতাদের জন্যেও। ১৮০টি মাটির খুরিতে ঘি মাখানো মাষকলাই উতসর্গ করা হয়। আগে বলির প্রচলন ছিল। মোষ কিংবা পাঁঠা বলি দেওয়া হত। এখন অবশ্য সে প্রথা উঠে গিয়েছে। অষ্টমীর দিন বলির প্রতীক হিসেবে মাষকলাই বলি দেওয়া হয়।
১৬১০ সালে, পুজো একটাই হত। তবে এখন সাবর্ণদের আটটি শরিকি বাড়িতে পুজো হয়। বড়িশাতেই রয়েছে ৬টি বাড়ি। আটচালা, বড়বাড়ি, মেজবাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকি বাড়ি ও কালিকিংকর ভবন। এ ছাড়া নিমতা ও উত্তর ২৪ পরগণার দুটি শরিকি বাড়িতেও পুজো হয়। মোটামুটি একই নিয়ম বহাল রয়েছে পুজোর। একমাত্র নিমতার বাড়ির পুজো ছাড়া বাকি সাতটি বাড়িতেই আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধিপুজোয় আবার ল্যাটা মাছ পোড়া দেওয়ার নিয়ম রয়েছে বলেও জানা যায়।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়িতে তিন মতে পুজো হয় দেবী দুর্গার। পঞ্চমী থেকে সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ পর্যন্ত বৈষ্ণব মতে পুজো। শাস্ত্র অনুযায়ী, সপ্তমীতে এক দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি আসেন মহাদেব। তাই ওই দিন পুজোর রীতি বদলে হয় শৈব মতে। আর সন্ধিপুজোর বলি হওয়ার পর থেকে তন্ত্র মতে পুজো হয়। পুজোর এই বিশেষ রীতির নাম ত্রিধারা।
সময় বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে স্থান। বংশপরম্পরায় পালটে গিয়েছেন পুজোর হোতারাও। তবুও প্রতি বছর পুজো আসে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়িতে। পুজো নিতে আসেন মা দুর্গা। কলকাতা শহরের সবচেয়ে পুরনো পুজো যে!