বাগে না পেলেই ধর্ষণের ভয় দেখাতে হবে নারীকে। পিতৃতন্ত্রের এই চেনা অভ্যাসটিকে চিহ্নিত করেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথও। রক্তকরবী নাটকে নন্দিনীর প্রসঙ্গেই সে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি।
সমাজের ক্ষমতার আসনে যে পিতৃতন্ত্র বসে আছে, সে যে নারীকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আর ক্ষমতা যার হাতে থাকে, ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সে সবসময়েই প্রতিপক্ষকে নিঃশেষে দমন করতে চায়। নিজের নানা লেখায় সেই ক্ষমতার রাজনীতিকে খতিয়ে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। নারীকে বাগে আনতে না পারলে পুরুষ যে ধর্ষণকে তার অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করে, সেই ইঙ্গিতও রয়ে গিয়েছে তাঁর লেখায়। আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে ‘রেপ থ্রেট’ বিষয়টি তো কোনও নারীর কাছেই অচেনা নয়। কোনও মেয়েকে গালি দিতে গিয়ে অনায়াসে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে বসে কোনও পুরুষ। কোনও মেয়ে প্রতিবাদে গলা চড়ালেও একইভাবে হুঁশিয়ারি আসে। পিতৃতন্ত্রের সেই অস্ত্র আসলে নতুন নয়। নারীর প্রতিবাদ আর সেই প্রতিবাদ থেকেই সামগ্রিক সংগ্রাম ঘনিয়ে ওঠার যে বৈগ্রহিক রচনা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, সেই ‘রক্তকরবী’ নাটকেও নন্দিনীর প্রসঙ্গেই ওই অস্ত্র ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি।
পিতৃতন্ত্র যে নানাভাবে নারীর শরীর ও মনকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে দলে-পিষে দেয়, আর তাকেই যে বলা চলে নারী-ধর্ষণ, রবীন্দ্রনাথ তা জানতেন না এমন নয়। ‘যোগাযোগ’-এর মতো উপন্যাসে সে কথা স্পষ্ট করেই লেখেন তিনি। যেখানে পড়তি জমিদার বাড়ির মেয়ে কুমুকে বিয়ে করেছে উঠতি ব্যবসায়ী মধুসূদন ঘোষাল। যে বিয়ে তার কাছে প্রতিপক্ষ বংশকে সর্বতোভাবে পিষে দেওয়া। অথচ কুমুকে বিয়ে করার পর সে বুঝতে পারে কিছুতেই এই মেয়েটিকে শরীরে মনে সে উপভোগ করতে পারছে না। কুমুর রুচিশীলতার নাগাল পায় না বলে তার পৌরুষ আহত হতে থাকে, আর সেই পৌরুষ শেষ পর্যন্ত নিজের দাঁত নখ প্রকাশ করে দাম্পত্য সঙ্গমে। সকালে নিরুপায় লজ্জায় ছাদে আশ্রয় নেয় যে বিধ্বস্ত কুমু, তার সেই বিধ্বস্ত শরীরের বিবরণে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে দেন সেই মিলনের মধ্যে কতখানি গ্লানি বহন করতে হয়েছে তাকে। বলপূর্বক সঙ্গম যে আসলে ক্ষমতার ভাষ্য, সেই কথাই এখানে বুঝিয়ে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন:
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে সবল হোক মেয়েরা, চাইতেন রবীন্দ্রনাথও
আর সেই ক্ষমতার ভাষ্যই ফিরে আসে পুঁজিতন্ত্রের ক্ষমতাশালায়। ‘রক্তকরবী’ নাটকের খনিশহর যক্ষপুরীতে মুনাফার জন্য খনিশ্রমিকদের চালনা করে সর্দারেরা। এই যান্ত্রিক পুঁজিতন্ত্রকে ভাঙতে চায় রঞ্জন ও নন্দিনী। সর্দাররা তাই পরিকল্পনা করে কৌশলে রাজাকে দিয়ে বিপ্লবী রঞ্জনকে খুন করায়। আর নন্দিনীর জন্য কি পরিকল্পনা তাদের? রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- সর্দার বলছে, ‘এবার কিন্তু ঐ মেয়েটাকে অবিলম্বে…’ অবিলম্বে কী করা হবে তা স্পষ্ট করে বলা না হলেও, সেই কাজের ইঙ্গিত রয়েছে মেজো সর্দারের কথায়- ‘না না, এ-সব কথা আমার সঙ্গে নয়। যে মোড়লের উপর ভার দেওয়া হয়েছে সে যোগ্য লোক, সে কোনোরকম নোংরামিকেই ভয় করে না।’ নাটকে গূঢ় কথা প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু একটি মেয়ের প্রতি কোনওরকম নোংরামি যে ধর্ষণ, তা আন্দাজ করে নিলে কি খুব ভুল হবে? পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের ‘নটীর পূজা’ প্রযোজনাতেও প্রতিবাদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুণীর ধর্ষণদৃশ্য তৈরি করেন পরিচালক কৌশিক সেন। নারীকে দমিয়ে, থামিয়ে দেওয়ার জন্য ধর্ষণকে যে পুরুষতন্ত্র হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করে, সেই হাতিয়ার সমাজে বহুপ্রচলিত বলেই তাকে চিনেছিলেন রবীন্দ্রনাথও।