আত্মকেন্দ্রিক একটা উড়ো পোকা ঘুরে ঘুরে এসে আমাদের শিখিয়েছিল, দূরে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমরা রপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম দূরত্ব বজায় রাখতে। এক মর্মান্তিক মৃত্যু সে সবকিছু ভুলিয়ে জাগিয়ে তুলল মানববন্ধনের দৃশ্য। দূরত্বের মহামারী অতিক্রম করে মানুষ পৌঁছেছে হাতে হাত রেখে জুড়ে জুড়ে থাকার অভিধানে। সেই ভয় না-পাওয়া কোজাগরীর কথা লিখলেন সরোজ দরবার।
করোনা এসেছিল। গুপ্ত ঘাতকের মতো। হাতে লুকনো ছুরিতে কেটে ফালাফালা করেছিল মানুষের যোগাযোগ। নাকি, একা করোনা নয়! বিচ্ছিন্নতা অস্ত্রে শান দিয়েছিল আখের গোছানোর রাজনীতিও! হয়তো সবই মিলেমিশে গিয়েছিল একসঙ্গে। আত্মকেন্দ্রিক একটা উড়ো পোকা ঘুরে ঘুরে এসে আমাদের শিখিয়েছিল, দূরে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমরা রপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম দূরত্ব বজায় রাখতে। আধুনিক অস্পৃশ্যতা। শরীরে ও মনে। মহামারী এসে যেন টান মেরে খুলে দিয়েছিল আমাদের মুখোশ। এই দূরত্ব কি তবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত? উদার অর্থনীতিতে সংঘ ভেঙেছে বহুদিন। সত্যের দেখা নেই। এক স্লোগানে অনেক মানুষ আর জড়ো হতে পারছিলেন না। দলের গায়ে লেগে আছে বিবিধ অভিসন্ধি। মানুষ, অতএব, বাহির হওয়ার দরজায় তুলে দিয়েছিল খিল। আপন হতে আপনে তার একঘেয়ে ক্লান্তিকর চলাচল। তবু কী এক জেদে নাকি ভয়ে, সে তা ভাঙতে চায় না কিছুতেই। ঠিক সেই সময় করোনা এসে বলেছিল, দূরে থাকো। মানুষ, খানিকটা স্বেচ্ছায়, মেনে নিয়েছিল সেই দূরত্বের নির্দেশিকা।
আরও শুনুন:
অন্ধকার সময়ের গান! আন্দোলন যদি নতুন সুরের জন্ম না দেয়, তবে ‘আর কবে’?
দূরত্বের সেই সংক্রমণ দেখে অনেকেই আঁতকে উঠেছিলেন। দূরত্বের প্রচার আর প্রসারের রবরবায় মনে হয়েছিল, মানুষ কি আবার হাতে হাত রেখে দাঁড়াতে পারবে! আর কি কখনও কবে এমন সময় হবে!
মহামারীর সেই সংকটকাল অবশ্য মানুষকে আর-এক বিন্দুতে এনেও দাঁড় করিয়েছিল। তা উপলব্ধির। সামান্য এক জীবাণু ধ্বংস করে দিতে পারে মানুষের এই এত প্রতাপ! সাম্রাজ্যের ভিত যেমন নড়িয়ে দেয় উইপোকা! তাহলে আর কীসের ব্যক্তিগত খোলস, কোন উইঢিবির ভিতর ঢুকে আত্মরক্ষা সম্ভব! কিছু মানুষ অন্তত সে চেষ্টা করেননি। তাঁরা দূরত্বের সেই ইস্তেহার নাকচ করে দিয়ে মানুষের পাশে থাকতেই চেয়েছিলেন। বিপর্যয় অলৌকিক নয়। তার কারণ থাকে। আর সেখান থেকে বেরোনোর পথ। দুটোই মানুষের হাতে। কূটনীতি তার যাবতীয় কূটপ্রশ্ন নিয়েই মেতে থাকে। তবে মানুষ জানে সে আদতে মানুষেরই জন্য। মহামারীর সেই দূরত্ব-বিধান অতএব একরকমের নৈকট্যের সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলেছিল। সেই সূত্রে চলে এসেছিল সহমর্মিতার কথা।
আরও শুনুন:
বাগে না পেলেই নারীকে ধর্ষণ? নন্দিনীর পরিণতিতে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ
সহমর্মিতা এমন এক গুণ, যা মানুষকে তার নিজের থেকে অনেকখানি বড় করে তোলে। সহমর্মী মানুষ অন্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন। তা সাকার করতে রাস্তাতেও নেমে পড়তে পারেন। শিল্প-সংস্কৃতির জগতে যখন স্যুররিয়ালিজম এল, তখন তো নিজের দিকে তাকানোর কথাই আবার বলা শুরু হল। সেই ঋত কথা, আত্মানাং বিদ্ধি। আপনাকে এই জানা আমার ফুরোবে না। এই নিজেকে জানা যত চলতে থাকবে, তত এক অন্য পৃথিবীর কল্পনা জেগে ওঠে। ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে মানুষ তখন নিজেকে অনেকটা উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে পারেন। তারই তো নানা রূপ বহুকাল আমাদের আশেপাশে প্রচলিত ছিল। পরে এল ইংরেজের হাত ধরে একধরনের শিক্ষা। সেই শিক্ষার কল কেবল চাকুরিজীবী তৈরি করে। মানুষের শ্রম আর উৎপাদনের ভিতর তেমন আর যোগ থাকে না। উপরন্তু জুটতে থাকে ইংরেজ সাহেবের গালি। উদার অর্থনীতিতে যা বদলে যাবে, কর্পোরেট ঊর্ধ্বতনের ধাতানিতে। ক্লান্ত মানুষ আশ্রয় খোঁজে আধ্যাত্মিকতার কথা। ঔপনিবেশিক ক্লান্তির পরিত্রাণ তাই হয়ে ওঠে কথামৃত। তবে, সহমর্মিতার অনুষ্ঠানে মানুষ যেন সেভাবে আর অংশ নিতে পারে। রাজনীতির ঘটনাক্রমে পালাবদল হয়। মানুষের মন বদলায় না। বরং দিনে দিনে তাতে জমে যায় স্বার্থের ধুলো। গোষ্ঠীর ধুলো। সম্প্রদায়ের ধুলো। পরিচিতির ছোট ছোট খোপ বেছে নিয়ে মানুষ আটকে ফেলে নিজেকে। রাজনীতি চালাকচতুর, অতএব এর ফায়দা তোলে। সুতরাং, আমরা বুঝতে পারি, করোনা অনুঘটক মাত্র। বিচ্ছিন্নতার মহামারীই আমাদের গভীর গভীরতর অসুখ।
আরও শুনুন:
‘দিনের পর দিন মিছিলেই তো ছিলাম’, ক্ষুব্ধ সময়ে পথ চেনার হদিশ দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ
এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার চর্চা এই খোপগুলো ভেঙে দেয়। মানুষকে সে টেনে আনে প্রসারিত ক্ষেত্রে। সমস্ত শ্রেণিবৈষম্য ঘুচিয়ে মানুষ তখন এক লক্ষ্যে এক সুতোয় বাঁধা পড়ে। ঠিক যেমন গোর্কির মা-এর সূত্রে সকলে বাঁধা পড়তে চেয়েছিল। এমপ্যাথি তাই পুরোদস্তুর রাজনৈতিক চর্চা। এক মর্মান্তিক মৃত্যু যখন গোটা বাংলাকে উদ্বেল করেছে, তখন ফিরে এসেছে সেই সহমর্মী দৃশ্যাবলিই। ভেদ নেই, বৈষম্য নেই। দল নেই, মতের মাতামাতিও নেই। শহরের জুনিয়র চিকিৎসকরা যখন পুলিশের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে আন্দোলন বাড়াচ্ছিলেন, বসেছিলেন অবস্থান বিক্ষোভে, তখন ধরা পড়েছিল এই ছবি। কেউ খাবার, কেউ জল এগিয়ে দিয়েছেন। কেউ দোকান কিংবা বাড়ির শৌচাগার ব্যবহার করতে দিয়েছেন। কেউ বা আবার ছোট একটা প্লাস্টিকের হাতপাখা দিয়ে সাহায্য করেছেন। এই যে সহমর্মিতার দৃশ্য, মানুষের এই জোটই আসলে যে কোনও শাসককে ভয় ধরায়। কেননা তা যে বৃহত্তর রাজনীতির কথা বলে, সেখানে হার মানে দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা। অতএব দলে দৌলতে আসীন শাসক তো মানুষের এই বন্ধন সমঝে চলবেই।
তবে, সময় আসে যখন সবকিছু ভুলে এই মানববন্ধনই স্থায়ী হয়ে যায়। এই শহর সাক্ষী থাকল সেই দৃশ্যেরও। হাতে-হাত রেখে কত মানুষ দাঁড়িয়ে জানালেন তাঁদের সংহতি। মানব-বন্ধনের ডাক ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। দূরত্বের মহামারী অতিক্রম করে মানুষ পৌঁছেছে হাতে হাত রেখে জুড়ে জুড়ে থাকার অভিধানে। বিপদে রক্ষা করা নয়, বিপদে ভয় না পাওয়াই তো আমাদের প্রার্থিত। মানব-বন্ধন সফল হলেই ভয় না-পাওয়া কোজাগরী ফুটে ওঠে সময়ের আকাশে।