পথের পাঁচালী। যেন বাঙালির সাংস্কৃতিক যাপনের এক অমোঘ অভিজ্ঞান। অথচ বিভূতিভূষণের এই কালজয়ী উপন্যাসটি আদৌ ছাপা হবে কি না, তা নিয়েই উঠেছিল প্রশ্ন। সেকালের এক নামী পত্রিকা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল এই উপন্যাস। আবার, তাঁর উপন্যাসই জন্ম দিয়েছিল এক নতুন পত্রিকার। শুনে নেওয়া যাক সেই গল্পই।
কাজ করেন জমিদারি সেরেস্তায়। স্বভাবে যেমন চুপচাপ তেমনই গম্ভীর ধরনের, যেটুকু কথা বলেন তাও একেবারে রসকষহীন। এঁর সঙ্গে আবার সাহিত্য নিয়ে কী আলোচনা করবেন, হতাশ হয়ে ভেবেছিলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু গরজ বড় বালাই। সেদিন আড্ডার বন্ধুরা আর কেউ আসেননি। অন্যদিন তাঁদের সঙ্গেই গানবাজনা আর সাহিত্য নিয়ে মজলিস জমে ওঠে। উপেন্দ্রনাথ পেশায় উকিল, আর ওকালতি করতেই তিনি কলকাতা ছেড়ে ভাগলপুরে এসেছেন, কিন্তু কলকাতার বিভিন্ন নামী পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরিয়েছে ইতিমধ্যেই। তাঁর আড্ডায় চেনা অচেনা অনেক বাঙালিই তাই আসেন, যেমন নিত্য যাওয়া আসা করেন এই প্রায়-অপরিচিত বাঙালি যুবকটিও। পরনে গোড়ালি ছুঁই-ছুঁই খাটো ধুতি, আর নিজের হাতে কাচা ইস্ত্রি-বিহীন মার্কিন কাপড়ের পাঞ্জাবি। এক হাতে লণ্ঠন, অপর হাতে লাঠি। সেদিন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আর কেউ না এলেও তিনি ঠিক এসে হাজির। বাধ্য হয়েই তাঁর সঙ্গেই আলাপ জমাবার চেষ্টা করলেন উপেন্দ্রনাথ। জানা গেল, যুবকের নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সাহিত্যিক আড্ডার টানেই রোজ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চার-পাঁচ মাইল পথ পেরিয়ে তিনি চলে আসেন। শুনে তো অবাক উপেন্দ্রনাথ। প্রশ্ন করে বসলেন, আপনার গোপনে সাহিত্যচর্চার বাতিক আছে নাকি? কিন্তু এই প্রশ্নের যে এমন উত্তর পাবেন, তা তিনি ভাবতেও পারেননি। অনেকেই কবিতা লিখে নিয়ে আসে তাঁর কাছে, তিনি দেখেশুনে সেসব ঠিক করে দেন। কিন্তু এই গ্রাম্য ধরনের যুবকটি নাকি গোটা একটা উপন্যাস লিখে বসেছেন! কোনও পত্রিকায় এ যাবৎ কোনও লেখা বেরোয়নি, না কবিতা, না গল্প, এমনকি একটা প্রবন্ধও না, সেই মানুষ নাকি সাহিত্যজগতে হাতেখড়ি না হতেই হাত দিয়েছেন উপন্যাসে! ছোট ছোট হাতের লেখায় চারশো পাতা জুড়ে লিখে গিয়েছেন, কী, না, কোনও এক গ্রামের কথা। বিস্ময়ে এবার আক্ষরিকভাবেই হাঁ হয়ে গেলেন উপেন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন: পুজোর শহর মাতল তাঁর অসম্ভবের ছন্দে, বাঙালিকে আজও ভাবায় সুকুমার রায়
সেদিনের সেই বৈঠকের গল্পই পরবর্তীকালে শুনিয়েছেন সাগরময় ঘোষ, তাঁর ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ বইয়ে। উপেন্দ্রনাথ মনে করতেন, উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদে ঠিক যতগুলি শব্দ আছে, তার পরের পরিচ্ছেদগুলিতেও ঠিক ততগুলিই শব্দ থাকবে। সে পরীক্ষাতেও দেখা গেল বিভূতিভূষণ ডাহা ফেল। প্রথম পরিচ্ছেদে ষোলশ শব্দ, তো দ্বিতীয়তে হাজার। তৃতীয় আর চতুর্থ প্রায় সমান, পঞ্চম খুব ছোট আর ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ বিরাট বড়। তাও কী মনে করে সে উপন্যাসটি একবার পড়ে দেখতে চাইলেন উপেন্দ্রনাথ। তাঁর কাছেই রয়ে গেল সেই পাণ্ডুলিপি। তারপর দিনের পর দিন কাটে, কিন্তু আর কোনও উচ্চবাচ্য নেই। বিভূতিভূষণই বা কী জিজ্ঞাসা করবেন? কলকাতায় থাকার সময়ে প্রবাসী পত্রিকায় জমা দিয়েছিলেন ছাপার জন্য, সেখান থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর উপেন্দ্রনাথ উপন্যাসের নিয়মকানুন নিয়ে যা বলেছেন, তাতে কোনও আশাই নেই।
মাস দুই পর বিভূতিভূষণের সব আশঙ্কা কাটিয়ে উপেন্দ্রনাথ স্বীকার করেছিলেন, সব লেখাকে অঙ্ক দিয়ে বিচার করা যায় না। শুধু তাই নয়, এ লেখা প্রকাশের সব দায়িত্ব তিনি তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধেই। তার জন্য ভাগলপুর ছেড়ে ফের পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। কী হয়েছিল তারপর? ‘সম্পাদকের বৈঠকে’-তে সাগরময় ঘোষ লিখছেন,
“তার কয়েক মাস পরেই মহা সমারোহে প্রকাশিত হল বিচিত্রা। প্রকাশ বললে ভুল হবে, বলা উচিত আবির্ভাব। প্রথম সংখ্যা যেদিন বেরল, তার আগের রাত্রে টালা-টু-টালিগঞ্জ-কলকাতার দেয়াল বিচিত্রার পোস্টারে ছেয়ে গেল। যাকে বলে এলাহি কারবার, ঢালোয়া ব্যাপার। সে ইতিহাস কারও অজানা নয়।
ওদিকে ভাগলপুরের নির্জনে বসে বিভূতিবাবু আশা নিয়ে মাস গুনছেন, উপন্যাস আর বেরোয় না। চিঠি লেখেন না, পাছে উপেনদা বিরক্ত হন। কিন্তু ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে।
কী একটা উপলক্ষ্যে বেশ কিছুদিনের ছুটি থাকায় বিভূতিবাবু কলকাতা যাওয়া স্থির করলেন।
ফড়িয়াপুকুর লেন-এর দোতলার একটি ঘরে জোর আড্ডা বসেছে। সোফাসেট-টিপয় সজ্জিত প্রকোষ্ঠে জন পাঁচেক সুটেড-বুটেড, ভদ্রলোক চায়ের পেয়ালায় ঝড় তুলে তর্ক করে চলেছেন সাহিত্যে শ্লীলতা আর অশ্লীলতা নিয়ে। সকলের মুখেই সিগারেট জ্বলছে, ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার। সেন্টার টেবিলে দামী ব্র্যাণ্ডের সিগারেটের টিন, চায়ের কাপ ইতস্তত ছড়ানো।
এমন সময় দরজার সামনে এক ভদ্রলোক উঁকি মারতেই পাচ-জোড়া চোখ তার উপর পড়ল। এত বাঙালী সাহেব-সুবো দেখে আগন্তুক খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে দরজার ওপারেই দাঁড়িয়ে রইলেন, ঘরে আর ঢুকলেন না। আধময়লা ধুতি, তাও প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি। জুতোর চামড়া ব্ল্যাক না ব্রাউন কলকাতার পথের ধুলোয় চেনবার উপায় নেই। গায়ে পাঞ্জাবি, তার দু-চার জায়গায় রিপুকর্মের চিহ্ন প্রকট। হাতে রয়েছে চটের থলি।
ঘর থেকে কে-একজন তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বললেন– কী চান এখানে? আপনি কি এজেন্ট? কোথাকার এজেন্ট? আপনাকে কিন্তু দশ কপির বেশি পত্রিকা দিতে পারব না। ভয়ানক ডিমাণ্ড। যান্ ওই কোণের ভদ্রলোকের কাছে টাকা জমা দিন।
আমি এজেন্ট নই।
তবে কি লেখক? কবিতা লিখেছেন? নাম ঠিকানা সমেত ওই কোণার ভদ্রলোকের কাছে জমা দিয়ে যান।
আমি লেখকও নই, কবিতা দিতেও আসি নি। আমি এসেছি পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে।
… এমন সময় উপেনদা এসে হাজির। দরজার কাছে যে-লোকটি এতক্ষণ ফিরে যাব-কি-যাব না ইতস্তত করছিল তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে ঘরে টেনে এনে বললেন—
কী খবর বিভূতিবাবু। কবে কলকাতায় এলেন? ভাগলপুরের সব খবর ভাল তো? বসুন, বসুন।
সোফায় সমাসীন যে-ভদ্রলোক তাকে এজেন্ট ঠাউরেছিলেন তার পাশেই জায়গা ছিল বসবার। বিভূতিবাবু বসলেন না। দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন–আজই সকালে কলকাতায় এসে পৌঁছেছি, রাত্রেই গ্রামে চলে যাব। হাতে একটু সময় ছিল, তাই আপনার সঙ্গে দেখা করে গেলাম।
তা এসে ভালই করেছেন। আপনাকে সুখবরটা দিই, আগামী সংখ্যা থেকেই আপনার উপন্যাস বেরোচ্ছে।
এতক্ষণ যারা তর্কে ঘর সরগরম করে রেখেছিলেন তারা এবার একেবারে চুপ। বার বার তাঁরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন বিভূতিবাবুর পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা।
বিভূতিবাবু আর মুহূর্তমাত্র না বাড়িয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। সেদিনের কলকাতা শহরের সন্ধ্যার আনন্দ তিনি কোনদিন ভোলেননি।”
আরও শুনুন: সংস্কৃত পণ্ডিতের সঙ্গে টানা হিন্দিতে কথাবার্তা, কেন এই পথ ধরেছিলেন বিদ্যাসাগর?
পরের মাস থেকেই বিচিত্রায় বেরোতে শুরু করল পথের পাঁচালী। সাহিত্যরসিক মহলে সাড়া পড়ে গেল, কে এই নতুন লেখক? বই ছাপার জন্য আগেভাগেই বিভূতিভূষণের জন্য চুক্তি করে বসলেন শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। আর পথের পাঁচালী-র সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা করে নিল নতুন পত্রিকা ‘বিচিত্রা’-ও।