কখনও রাস্তায়। কখনও মেট্রোয়। কখনও ঘরেই, চার দেওয়ালের মধ্যে। কবে, কোথায়,কীভাবে বিপদ আসবে, কেউ জানে না। উপায় একটাই, নিজেকে তৈরি করা। শরীর, মন এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে বিপদের মোকাবিলায় একাই একশো হয়ে ওঠা যায়। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সেই গল্পই শোনালেন রাজলক্ষ্মী ভট্টাচার্য। মুখোমুখি শুভদীপ রায়।
আর জি করের নারকীয় কাণ্ড মহিলাদের সামগ্রিক বিপন্নতার ছবিটা নতুন করে স্পষ্ট করেছে। এই আবহে মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। কিন্তু এই ঘটনাই তো প্রথম নয়। যুগ যুগ ধরে মহিলারাই অত্যাচার, নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন। কখনও প্রতিবাদে গর্জে উঠছেন তাঁরা। কখনও মুখ বুঝে সহ্য করছেন। তবে সহ্যেরও একটা সীমা রয়েছে। সেটা পেরোলে চণ্ডী হয়ে উঠতে হয় নারীকেই। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এমনই এক গল্পের কথা শোনালেন রাজলক্ষ্মী। দীর্ঘদিন মার্শাল আর্ট শিখেছেন। এই শিক্ষাই তাঁকে লড়াই করে ফিরতে শিখিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক মহিলার জন্য এই মার্শাল আর্ট বা সেলফ ডিফেন্সের পাঠ কতটা জরুরি, তা বোঝালেন।
আরও শুনুন:
একসঙ্গে ৫-৬ জন ঘিরে ধরলেও বাঁচা সম্ভব? জানালেন কারাটে প্রশিক্ষকরা
ঠিক কী হয়েছিল?
ঘটনা ২০১২ সালের। সেই সময় রাজলক্ষ্মী কলকাতার বাসিন্দা। বছর দুই আগে বিয়ে হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে সুখের সংসার। তবে সমস্যা ছিল ঘরের বাইরে। স্ট্যান্ড অ্যালোন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এই পরিবারের প্রধান সমস্যা ছিল সামনের ফ্ল্যাটের অবিবাহিত কয়েকজন পুরুষ। প্রত্যেকেই কলেজ পড়ুয়া। কিন্তু জীবনযাপন লাগামছাড়া। নেশা করে উৎপাত লেগেই থাকত। অতিষ্ঠ হয়ে বহুবার নিষেধ করেছেন রাজলক্ষ্মী ও তাঁর স্বামী। তাতে লাভ হয়নি কিছুই। বরং শুনতে হয়েছে হুমকি। প্রথমদিকে কলেজ পড়ুয়াদের এই আচরণ দেখে বেশ আতঙ্কে দিন কাটাতেন রাজলক্ষ্মী। সামনে বেরোতে ভয় পেতেন। এভাবেই দিন কাটছিল। এদিকে বারবার রাজলক্ষ্মীর পরিবারের তরফে বাধা পেয়ে ছেলের দল প্রতিশোধের ছক কষেছিল। অপেক্ষা ছিল সঠিক সুযোগের। একদিন রাজলক্ষ্মীর স্বামীকে রাস্তায় একা পেয়ে চেপে ধরেন দুজন। চেহারায় তাঁরা বেশ লম্বা চওড়া। কিছু বোঝার আগেই ওই দুজন মারতে শুরু করেন রাজলক্ষ্মীর স্বামীকে। সেই ঘটনা দূর থেকে চোখে পড়ে রাজলক্ষ্মীর। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে তিনি ছুটে যান। নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েন ওই দুজন দুষ্কৃতীর উপর। মার্শাল আর্টের কৌশল কাজে লাগিয়ে দুজনকে পরাস্ত করে ফেলেন একাই। ততক্ষণে পাড়ার আরও অনেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁরাই ব্যাপারটা সামলে নেন। তবে সেই মুহূর্তে রাজলক্ষ্মী ঝাঁপিয়ে না পড়লে অন্য বিপদ হতে পারত।
কিন্তু একবারও কি ভয় লাগেনি?
রাজলক্ষ্মীর কথায়, ভয় অবশ্যই লেগেছিল। কিন্তু মার্শাল আর্টের শিক্ষা মানসিক দৃঢ়তার পাঠও তাঁকে দিয়েছিল। আর সেই জোরেই বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পেরেছিলেন। একদিনে সেই বিদ্যা রপ্ত হয়নি। দিনের পর দিন নিজেকে অভ্যাসের মধ্যে রেখেছিলেন। তাতের বেড়েছিল রিফ্লেক্স। শুধু সেদিনের ঘটনা নয়। রাজলক্ষ্মীর কথায় উঠে এল আরও অনেক ঘটনার প্রসঙ্গই। তবে আগে থেকেই সচেতন হয়ে যাওয়ায় বড় বিপদ হয়নি। উদাহরণ হিসেবে ধর্মতলায় ভিড়ের মাঝে হাঁটার কথা বললেন রাজলক্ষ্মী। সামনে থেকে আসা কোনও পুরুষ ইচ্ছা করে শরীর ছুঁতে চাইছেন, সেটা আগেই বুঝে ফেলতেন তিনি। সেইমতো পদক্ষেপ করতেন। তাতে নিজে তো বাঁচতেনই, সেইসঙ্গে নিজের ভুল ভালমতো টের পেত সেই পুরুষটিও।
আরও শুনুন:
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে সবল হোক মেয়েরা, চাইতেন রবীন্দ্রনাথও
পুরনো অভিজ্ঞতা। তাও ঘটনার কথা বলতে গিয়ে একবারও গলা কাঁপেনি রাজলক্ষ্মীর। একা একজন মহিলার পক্ষে লড়াই করে ফিরে আসা যে বাস্তবেই সম্ভব, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে একদিনে হবে না। নিয়মিত অভ্যাসের মধ্যে থাকলে এমনটা সম্ভব, মনে করছেন রাজলক্ষ্মী। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনিও উদ্বিগ্ন। তবে আতঙ্কিত নন। বিপদে পড়লে কীভাবে বেঁচে ফিরতে হয় সে শিক্ষা তাঁর রয়েছে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরস্থিতি মোকাবিলা করতেও তিনি জানেন। তাঁর মতো আরও অনেকেই এই শিক্ষা পান, এমনটাই চেয়েছেন রাজলক্ষ্মী। শুধুমাত্র শরীরচর্চা নয়, আত্মরক্ষার সঠিক কৌশল শিখলেই বিপদ এড়ানো সম্ভব। কবে, কোথায়, কীভাবে সমস্যা দেখা দেবে, তার আগাম পূর্বাভাস সবসময় মেলে না। সেক্ষেত্রে একমাত্র সহায় হতে পারে মার্শাল আর্টের কৌশল। সবসময় যে লড়াই করেই বাঁচতে হবে তার মানে নেই। রাজলক্ষ্মীর কথায়, উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে পালিয়ে যেতে পারলেও হবে। উদ্দেশ্য একটাই নিজেকে সুরক্ষিত রাখা। তার জন্য যা করা প্রয়োজন সেটাই করতে হবে। এমনটাই জানালেন রাজলক্ষ্মী ভট্টাচার্য।