দেশের রাজনীতি কি মতাদর্শগত বিরোধের জায়গা থেকে নতুন করে এগিয়ে যাবে! গান্ধী বনাম সাভারকরের বিন্দু থেকে শুরু হবে কোনও নতুন ভারত-যাত্রা! নাকি আরও একবার তা হারিয়ে যাবে ভোট-রাজনীতির জঙ্গলে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে নানা মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
আমি সাভারকর নই, গান্ধী। অতএব ক্ষমা চাইব না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাহুল গান্ধীর এই মন্তব্য সমসাময়িক কালের রাজনীতিতে সবথেকে বলিষ্ঠ একটি বিবৃতি। ভারত-জোড়ো-যাত্রার মাধ্যমে সংঘ পরিবারের সঙ্গে যে আদর্শগত বিরোধের কথা তুলে ধরেছিলেন রাহুল, তা যেন সংহত-সংক্ষিপ্ত ও দৃঢ় রূপ পেয়েছে এই বিবৃতিতে। উদ্ধব ঠাকরে থেকে সঞ্জয় রাউত – যাঁরা রাজনৈতিক ভাবে বিজেপির বিরোধী হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেন- তাঁরাও যেভাবে সাভারকরের উল্লেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তাতে বোঝা যায় রাহুলের তির মোক্ষম জায়গাতেই বিঁধেছে।
আরও শুনুন: একটি গাছের পরিচর্যায় খরচ ১২ লক্ষ টাকা, দিনরাত পাহারা দেয় সশস্ত্র প্রহরী, কেন জানেন?
এই কথাটা যে রাহুল এই প্রথমবার বলতে চাইলেন, তা কিন্তু নয়। তবে এত স্পষ্ট করে বোধহয় এর আগে বলেননি। ভারত-জোড়ো-যাত্রার সময় ঘৃণা-বিদ্বেষ-বিভেদের বিরুদ্ধে ভালবাসার কথা বলেছেন। বিচ্ছিন্নতার বিপ্রতীপে জুড়ে-জুড়ে থাকার কথা বলেছিলেন। গণতন্ত্র রক্ষা, সংবিধানকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বারবার বলেছেন। উলটোদিকে তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ। রাহুল তার উত্তরও দিয়েছেন কখনও-সখনও। তবে যেভাবে গান্ধী পরিবার ও তাঁদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, তার জবাব খুব যে স্পষ্ট কথায় রাহুল দিয়েছেন তা নয়। দেশের ইতিহাস থেকে নেহরুকে কার্যত মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে নানাভাবে, এমন কথা তো প্রায়শই শোনা যায়। দেশের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলিই সোচ্চারে বলে যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতর আঘাত নেমে আসছে। গণতন্ত্র বিপন্ন হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। রাহুল ঠিক সেই কথাগুলিই বলে চলেছেন ধারাবাহিক ভাবে। বলা যায়, যে ‘পাপ্পু’ ইমেজের মধ্যে তাঁকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে জোরালো বিরোধী স্বর হিসাবেই নিজেকে মেলে ধরেছিলেন রাহুল। অনেকেই বলছেন, সেই স্বরকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হিসাবেই সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপ। যদিও বিষয়টির আইনগত জটিলতা আছে, তবু এ কথা তো বলাই যায় যে, সংঘ পরিবারের আদর্শের সার্থক বিরোধীই হয়ে উঠেছেন রাহুল। তিনি তাঁর আদর্শে স্থিত। অতএব তাঁর ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন নেই। নিজের মন্তব্যে সাভারকরের প্রসঙ্গ টেনে এনে রাহুল তাই এবার জাতীয় রাজনীতিকে আবার গান্ধী বনাম সাভারকরের বিন্দুতেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আরও শুনুন: রাহুলের মন্তব্যে বিপাকে কংগ্রেস! হাত-শিবিরের অন্দরেই অসন্তোষ, ফাঁস কিরেণ রিজিজুর
প্রশ্ন একটাই, এই বিন্দু থেকে কি দেশের রাজনীতি বদলাবে! নাকি এই পর্বও আসলে ভোটসর্বস্ব রাজনীতিতে তলিয়ে যাবে! রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাহুলের বিরুদ্ধে এই যে পদক্ষেপ, তা বিজেপির ভোট-রাজনীতির এক কৌশলও হতে পারে। রাহুলের এই হেনস্তাই যদি কংগ্রেসের রাজনীতির মুখ্য অভিমুখ হয়ে ওঠে, তবে প্রত্যাশিত ভাবেই তারা আক্রমণ শানাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে। আপাতত সামনে যে যে জায়গায় নির্বাচন আছে, সেখানকার স্থানীয় ইস্যুর বদলে এর ফলে অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে পারে মোদি বনাম রাহুল যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে জনপ্রিয়তার নিরিখে মোদির পাল্লা ভারীর দিকেই হয়তো ঝুঁকবে। অর্থাৎ স্থানীয় ইস্যুর বদলে ভোট-রাজনীতির আখ্যান রাহুল-মোদিতে বদলে গেলে, বিজেপির সুবিধা হবে বলেই মনে করছেন অনেকে। বিগত ২০১৯-এর নির্বাচনে ভোটযুদ্ধের বয়ান অনেকটা এরকমই ছিল। সেই বয়ানই কি কৌশলে ফিরিয়ে আনা হল! প্রশ্ন অনেকেরই। আরও একটি দিক এখানে থেকে যায়। এই ঘটনার পর কংগ্রেস নিজেকে ভোটযুদ্ধে অনেকটাই বলীয়ান মনে করবে। এদিকে আঞ্চলিক দলগুলিও কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ‘একলা চলো’ নীতির পক্ষপাতী। যদিও জোট-সম্ভাবনা প্রায় নেই, তবু রাহুলই ভোটের মুখ হয়ে উঠলে বিরোধী-ঐক্য যে কোনোভাবেই থাকবে না, সে ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিতই হতে পারে পদ্ম-শিবির। অর্থাৎ রাহুলের এই হেনস্তা কংগ্রেসের ভোটযুদ্ধের অশ্বমেধের ঘোড়া হলে, কংগ্রেসের যা লাভ হওয়ার হবে, উলটোদিকে খানিক লাভবান বিজেপিও হতে পারে। এমনটা মনে করছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
তাহলে দেশের রাজনীতি কি মতাদর্শগত বিরোধের জায়গা থেকে নতুন করে এগিয়ে যাবে! গান্ধী বনাম সাভারকরের বিন্দু থেকে শুরু হবে কোনও নতুন ভারত-যাত্রা! নাকি আরও একবার তা হারিয়ে যাবে ভোট-রাজনীতির জঙ্গলে। সে উত্তর আপাতত সময়ের হাতেই তোলা।