অনিবার্য ভাবেই বড়দের পৃথিবী থেকে যুদ্ধের যাবতীয় ভয়াবহতা সুযোগ পেয়ে ঢুকে এসেছে ছোটদের জগতেও। কারণ সত্যি বলতে কোনও দেশ যদি যুদ্ধে অংশ নেয়, তাহলে শিশুরাও তার প্রকোপ থেকে দূরে থাকতে পারে না। সামাজিক যা কিছু পরিবর্তন ঘটে, সে সবকিছুরই প্রভাব পড়ে তাদের জীবনেও। সে জন্যই সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাবার মৃত্যুতে তাঁর একরত্তি মেয়ে অঙ্গীকার করে বসে, শত্রু দেশের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার! কখনও বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রসঙ্গ তুলে বিবাদে জড়ায় স্কুলপড়ুয়ারা।
পৃথিবীতে যতবার নতুন করে যুদ্ধ হয়েছে, ধ্বংসলীলার সাক্ষী হয়ে থেকেছে কোনও সভ্যতা, ততবার নতুন ভোর এসেছে শিশুদের হাত ধরেই। রণক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া কোনও প্রজন্মকে শিশুরাই নতুন স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। এ ঘটনা নতুন নয়, তবুও তো নতুন করে অবাক হতে হয় যখন একরত্তি কোনও খুদে দাবি করে বসে, সে নাকি তার আজন্মের সমস্ত সঞ্চয় তুলে দিতে চায় দেশের সেনাবাহিনীর হাতে! আর অবাক হবে না-ই বা কীকরে? বড়দের আপাত-বিবর্ণ পৃথিবীটাকেই অনেক বেশি রঙিন বলে ঠাওর হয়ে শিশুদের চোখে। চকচকে বোতাম, রাংতার মোড়ক, বন্দুকের ক্যাপ, সবই বড় লোভনীয় বোধ হয় তাদের। বাকি জগতের কাছে যা সামান্য, তাই শিশুরা মহার্ঘ্য বলে আঁকড়ে ধরে। আর এক্ষেত্রে তো তা সত্যিই মূল্যবান!
পহেলগাঁও হামলার পর প্রায় এক মাস পেরিয়েছে। মাঝের দিনগুলো কেটেছে অত্যন্ত ঘটনাবহুল। সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলে বারবার উঠে এসেছে ‘যুদ্ধ’, ‘সংঘাত’, ‘সন্ত্রাস’-এর মতো শব্দ। অনিবার্য ভাবেই বড়দের পৃথিবী থেকে যুদ্ধের যাবতীয় ভয়াবহতা সুযোগ পেয়ে ঢুকে এসেছে ছোটদের জগতেও। কারণ সত্যি বলতে কোনও দেশ যদি যুদ্ধে অংশ নেয়, তাহলে শিশুরাও তার প্রকোপ থেকে দূরে থাকতে পারে না। সামাজিক যা কিছু পরিবর্তন ঘটে, সে সবকিছুরই প্রভাব পড়ে তাদের জীবনেও। সে জন্যই সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাবার মৃত্যুতে তাঁর একরত্তি মেয়ে অঙ্গীকার করে বসে, শত্রু দেশের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার! কখনও বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রসঙ্গ তুলে বিবাদে জড়ায় স্কুলপড়ুয়ারা।
আর এরই মাঝে রয়ে যায় তামিলনাড়ুর কারুর গ্রামের বাসিন্দা, এক আট বছর বয়সী খুদের গল্পটাও। গত দশ মাস ধরে নিজের ছোট্ট পিগিব্যাঙ্কে তিল তিল করে টাকা জমাচ্ছিল সে। বাড়ির বড়দের থেকে যখন যেমনটা পাওয়া যাচ্ছিল, তাই জমা পড়ছিল পয়সার ভাঁড়খানায়। অনেক টাকা জমলে হয়তো নতুন জুতো কেনা যেত, কিংবা নতুন খেলনা। আরও অনেক বেশি জমলে হয়তো রঙচঙে ট্রাইসাইকেল। কিন্তু তার আগেই যে যুদ্ধ এসে গেল! সশরীরে না এসে পৌঁছালেও, টিভি অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে দেশব্যাপী সংঘাতের কথা ঢুকেই পড়ল তামিল নাড়ুর বেনামী গ্রামটিতে। যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা যেমন জানল, তেমনি সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগের কাহিনীও জানা হল শিশুটির। সীমান্তে দেশের জন্য লড়ে যাওয়া সৈনিকরা তার মনে ধরা দিল আনকোরা নতুন সুপারহিরোর মতো।
আর তখনই সে ঠিক করে নিল, এতদিনের তার যা কিছু সঞ্চয়, সবটুকু খালি করে দেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তহবিলে। হয়তো অর্থমূল্যের দিক থেকে তা বিশাল কিছু নয়; কিন্তু তাতে মিশে রয়েছে ওই একরত্তির একবুক আবেগ, ইচ্ছে, স্বপ্ন। বড়রাও যেখানে নিজের ভাগ থেকে দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে যান, সেখানে এই খুদের ত্যাগ দেখার মতো বিষয় বৈকি! কি স্পষ্ট তার মননে দেশাত্মবোধের ধারণা! আত্মত্যাগ ছাড়া যে বৃহত্তর ভালোর পথ প্রশস্ত হওয়া সম্ভব নয়, সে ধারণা যেন ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে তার।
কান পাতলে শোনা যায়, অহরহ নতুন প্রজন্মের নামে অভিযোগ করছেন পুরনোরা। অন্যের জন্য ভাবা, ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে বেরিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ানো – এ সমস্ত বৈশিষ্ট্য যে একেবারেই নেই নতুনদের মধ্যে, তাই পুরনোরা বারে বারে মনে করিয়ে দেন। তারপরেও যুদ্ধবিধস্ত গাজার দুইদিন না খেয়ে থাকা শিশু নিজের খাবার তুলে দেয় ক্ষুধার্ত বিড়ালের মুখে। উত্তরপ্রদেশের নাবালিকা ১৭ দিনের অনশনে বসে পাড়ার মদের দোকান ভাঙার দাবিতে। সত্যিই কি আলাদা করে রাখা যায় বড়দের আর ছোটদের পৃথিবী? সত্যিই কি ছোটরা, বড়দের পৃথিবীর সমস্যাগুলো বুঝে উঠতে পারে না? নাকি ভালোবাসা, ত্যাগ, দেশাত্মবোধ সব ক্ষেত্রেই নতুন নজির গড়তে চায় আগামীর শিশুরা?