কৃষক আন্দোলনের রেশ সেভাবে ভোটবাক্সের মন কাড়তে পারেনি। বলা যায়, অন্য ইস্যুকে এত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি, কৃষকদের দাবি-দাওয়া সেখানে আর গণ্য হয়নি। সবুজ বিপ্লবের জনককে ভারতরত্নে ভূষিত করা হচ্ছে। এদিকে, কৃষক, যাঁরা ভারতের রত্ন, তাঁরা কি চিরকাল উপেক্ষিতই থেকে যাবেন দেশের মানুষের কাছে!
আবার আন্দোলন। অবরোধ। বৈঠক, ব্যর্থতা, ফের আন্দোলন। কৃষক আন্দোলনের সেই চেনা ছবি ফিরেছে দেশে। দিকে দিকে আবার শুরু হয়েছে আলোচনা। কৃষিপ্রধান এই দেশে কেন বারবার কৃষকদের দাবি আদায়ের জন্য পথে নামতে হচ্ছে? ফিরে ফিরে আসছে এই প্রশ্ন। তবে, ঘটনা হল, অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন ছাড়া আর কোনও পথ বোধহয় কৃষকদের সামনে খোলা নেই।
গতবারের আন্দোলনের থেকে এবারের আন্দোলন চরিত্রগত ভাবে ভিন্ন। দাবি-দাওয়া আলাদা। তবে, একটা কথা মানতেই হয়; তা হল, কৃষকরা তাঁদের প্রাপ্য পাচ্ছেন না। নিজেদের বঞ্চিত মনে করছেন। ফসল তো শ্রম আর ঘামের ফসল। তাহলে, তার জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তাঁরা পাবেন নাই-ই বা কেন! এই সহজ কথার সহজ উত্তর যেন মিলতেই চায় না।
আরও শুনুন: নির্বাচনী বন্ড অসাংবিধানিক! অনুদানের অস্বচ্ছতার ‘কোভিডে’ কি ‘ভ্যাকসিন’ হবে সুপ্রিম রায়?
এই মুহূর্তে কৃষকদের মূলদাবি তিনটি- ঋণ মকুব, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের জন্য আইন আনা, স্বামীনাথন কমিশনের প্রস্তাব লাগু করা। তিনটি দাবিই সঙ্গত। বড় বড় ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপির ঘটনা তো দেশের অজানা নয়, যেমন জানা ঋণমকুবের কথা। কৃষকদের ক্ষেত্রে কি কোনও প্রকল্প এনে তা করা যায় না? প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত হলে কৃষকদের মাথায় হাত পড়ে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের তাই স্থির কাঠামো জরুরি। এবং স্বামীনাথন কমিশনের প্রস্তাব যে দীর্ঘকাল বাস্তবায়িত হচ্ছে না তা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই। ফলত বারংবার দাবির চরিত্র বদলায়, তবে কৃষকদের পথে নামার ছবি পালটায় না।
দফায় দফায় বৈঠক চলছে, হয়তো রফাসূত্র বেরোবে। তবে ফিরে ফিরে আসা এই কৃষক আন্দোলন কিন্তু একটা প্রশ্নের দিকেই আমাদের ঠেলে দিচ্ছে। শুধু সরকার নয়, দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ কি কৃষকদের কথা, তাঁদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করেন! যদি করেও থাকেন, আদৌ কি ভোটবাক্সে তার প্রভাব পড়ে? এর সরল উত্তর, না। ভোটের ইস্যুতে কখনই কৃষি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিতে পারে না। ধর্ম থেকে বর্ণ, দেনা থেকে পাওনা যেভাবে ভোটের হাওয়া ঘুরিয়ে দেয়, তাতে অন্নদাতাদের আর্তনাদ কানেই আসে না যেন! বেশ কয়েকটি রাজ্যের ভোটচিত্রের সিকে তাকালে তার আন্দাজ পাওয়া যায়। মধ্যপ্রদেশে কৃষকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ নতুন নয়। দু-দশকের বিজেপি শাসন সত্ত্বেও সেখানে এই ক্ষোভ পুরোপুরি মেটেনি, যদিও তাতে বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকায়নি। ২০২৩-এর ভোট তার সাক্ষী থেকেছে। অথচ মধ্যপ্রদেশে অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষই কৃষির সঙ্গে যুক্ত। ভোট-পরবর্তী এক সমীক্ষা জানান দিয়েছিল, উত্তরদাতাদের ২২ শতাংশ মাত্র মনে করেন যে, কৃষকদের অবস্থার অবনতি হয়েছে। ৩৪ শতাংশের মত ছিল উলটোদিকেই।
আরও শুনুন: মন্দির বেশি হলে হিন্দুরা অন্য ধর্মে যাবেন না! বাড়ছে ধর্মান্তর আটকানোর নয়া ভাবনা
একই ছবি রাজস্থানে, সেখানে কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ৬২ শতাংশ। সেখানেও মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ কৃষকদের দুরবস্থা নিয়ে ভাবিত ছিলেন। আবার ২০২২ উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের দিকে তাকালেও ছবিটার তেমন হেরফের হয় না। সেখানে ৪২ শতাংশ মানুষের মত ছিল যে কৃষকদের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, তবে যোগী আদিত্যনাথ কিন্তু অনেক বেশি সমর্থন নিয়েই সেবার ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ সবই হয়েছে ২০২১-এর কৃষক আন্দোলনের পরে। অর্থাৎ কৃষক আন্দোলনের রেশ সেভাবে ভোটবাক্সের মন কাড়তে পারেনি। বলা যায়, অন্য ইস্যুকে এত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি, কৃষকদের দাবি-দাওয়া সেখানে আর গণ্য হয়নি। হয়তো কৃষকরা নিজেরাও ভোটের হাওয়ায় প্রভাবিত হয়েছেন, এমনটা হওয়াও অসম্ভব নয়।
ফলত, ভোট এসেছে, ভোট গিয়েছে। কৃষকদের অবস্থা বদলায়নি। অপ্রাপ্তি নিয়ে তাঁদের আবার সরব হতে হয়েছে। প্রশ্ন সেই একই, আদৌ কি ফসলের কান্না ভোটবাক্সের মন বদলাতে পারবে! উত্তর জানা নেই। সবুজ বিপ্লবের জনককে ভারতরত্নে ভূষিত করা হচ্ছে। এদিকে, কৃষক, যাঁরা ভারতের রত্ন, তাঁরা কি চিরকাল উপেক্ষিতই থেকে যাবেন দেশের মানুষের কাছে! উত্তর মেলে না।