আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে আলোচনার একেবারে কেন্দ্রে চলে এসেছে রামমন্দির। শাসক কিংবা বিরোধী, দুই পক্ষেরই মত যে, তা নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। কিন্তু মন্দির নির্মাণ কি আদৌ তা প্রভাবিত করতে পারে? নাকি মন্দির নির্মাণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়তে পারে? রাজনীতি পেরিয়ে তারই উত্তর দিয়েছেন দেশের মানুষ। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ভোটের অঙ্ক যে বেশ গোলমেলে, তা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রায় সকলেই জানেন। কেননা ভোটারের মন হল রহস্যময় ধাঁধা। যেখানে নৌকাডুবির ভয় বলে কিছু থাকতেও পারে না, সেখানেও ভরাডুবি হতে পারে। আর তাই সবরকম অনিশ্চয়তাকে নিশ্চয়তায় বদলে দিতে তাঁরা নিরন্তর চেষ্টা করেন। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মন্দির নির্মাণ রীতিমতো আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখার চেষ্টা হলেও, বর্তমান ভারতে দুটিই বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। ফলত, মন্দির ইস্যুকে আর ভোটের রাজনীতির বাইরে রাখা যাচ্ছে না। তবে, প্রশ্ন একটাই যে, সেই মন্দির নিয়ে কী বলছে ভোটারের মন? কেননা সেখানেই আছে আসল গুপ্তধন, যা ভোটবাক্সে ম্যাজিক দেখায়।
আরও শুনুন: ভোটের বাজার হাজারও দুর্নীতির অভিযোগে সরগরম, আদৌ কি তাতে প্রভাবিত হন ভোটাররা?
ভারতবর্ষে বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মের মানুষের বাস; সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সংস্কৃতির প্রভেদ আছে। তবে, সংবিধানের আওতায় সেই ভিন্নতাকে মাথায় রেখেই দেশবাসী বহুকাল মিলেমিশে থেকেছেন। সেই বাঁধনে কি চিড় ধরাতে পারে মন্দির? যেহেতু মন্দির মূলত একটি সম্প্রদায়ের ধর্মেরই প্রার্থনাস্থল, তা কি প্রমাণ করে দিতে পারে যে, দেশের কর্তাব্যক্তিরা কেবল একটি সম্প্রদায়কেই প্রাধান্য দিচ্ছেন? এ প্রশ্ন সঙ্গত। এবং সম্প্রতি ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জলহাওয়ায় যে বড় বদল এসেছে, তাতে এই প্রশ্ন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এ কথা ঠিক যে, ভারতবর্ষের মতো দেশে ধর্ম, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রভাব মানুষের উপর বেশ প্রবল ভাবেই আছে। এটি এমন একটি স্পর্শকাতর জায়গা যা দেশকে বারবার কাতরও করেছে। ধর্মভিত্তিক অশান্তির সাক্ষী থেকেছে দেশ। আবার সেসব মিটিয়ে মন দিয়েছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রাথমিক চাহিদায়। তবে, রাজনৈতিক স্তর থেকে যদি ধর্ম বা নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের উপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সামাজিক বন্ধনের যে নকশা তাতেও বদল আসতে বাধ্য। সাম্প্রতিক অতীতে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে, যা দেখে সেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বহু মানুষ।
আরও শুনুন: প্রথমবার আঙুলে কালি, ভোটের খেলা ঘুরিয়ে দিতে ওস্তাদ নতুন ভোটাররাও
রাজনীতির এই সব প্যাচপয়জারের বাইরেও যা থাকে, তা হল দেশের মানুষের সম্মিলিত বোধ। সেখানে কিন্তু এই মিলেমিশে থাকা বা ঐক্যের ধারণা সহজে নষ্ট হয় না। সম্প্রতি এই বিষয়ে খোঁজ চালিয়েছিল একটি সংস্থা, যার ফলাফল প্রকাশিত হয় এক সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমে। সেখানে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। দেশের আমজনতার ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই জানিয়েছেন যে, দেশ যে কেবল এক ধর্মের মানুষেরই, এমনটা তাঁরা বিশ্বাস করেন না। বরং বিশ্বাস করেন যে, দেশ তো সব ধর্মের মানুষেরই, সেখানে সকলেই সমান। অল্পসংখ্যক মানুষই জানিয়েছেন যে, ভারতবর্ষ শুধু হিন্দুদের। প্রায় ১৯টি রাজ্য জুড়ে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সেখানেই গরিষ্ঠসংখ্যক উত্তরদাতারা এ কথা জানিয়েছেন। সন্দেহ নেই যে, ভোটের মুখে মানুষের এই মনের কথা অন্যরকম একটি বার্তাই বয়ে আনছে।
আরও শুনুন: রাজনীতির উপরে থাকুক আইন-সংবিধান, দেশ বাঁচাতেই মনে করাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি?
তাহলে, মন্দির নির্মাণ কি সত্যিই ভোটকে প্রভাবিত করতে পারে? তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ মানুষের বক্তব্য যে, মন্দির নির্মাণ হিন্দু পরিচিতি বা সত্তাকে ঐক্যবদ্ধ করবে। কেবল ২৫ শতাংশ মানুষ এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আবার ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন যে, মন্দির নির্মাণের দরুণ সম্প্রদায়ের সম্প্রদায়ের যে বাঁধন তা দৃঢ়ই হবে। ২৪ শতাংশ মানুষ বরং মনে করছেন, এতে বিভেদ বাড়বে বই কমবে না!
আরও শুনুন: প্রচারের আলোয় রামলালা, তবে মন্দির অর্থনীতিতে বাজিমাত কাশীর বিশ্বনাথেরই
আসলে জনতা বললে যা বোঝা যায় তা কোনও একরৈখিক তালগোল পাকানো ব্যাপার। তা তো বহু মানুষেরই সমষ্টিগত রূপ। তাই মানুষের মতে মতে পার্থক্য থাকবেই। এই সমীক্ষাই সেই ইঙ্গিত দিছে। একদিকে যেমন মানুষ মনে করছেন দেশ সব ধর্মের মানুষেরই, তেমনই মন্দির নির্মাণ যে একটা সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করবে, তাও তাঁরা মনে করছেন। ফলে, এর প্রভাব ভোটে পড়তেই পারে। আসলে এই সবরকম সম্ভাবনা মিলেমিশেই এগিয়ে যায় জনজীবন। তবে, মানুষের ভিন্নমতই যে দেশের চালিকাশক্তি, এই সমীক্ষা যেন সে কথাই আরও একবার মনে করিয়ে দিল।