সম্প্রীতির ভারত যে হারিয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে আক্ষেপ করেন অনেকেই। দেশের সংখ্যাগুরুদের কাছে এখনও সংখ্যালগুদের পার্বণ ‘ওদের’ অনুষ্ঠান হয়েই থেকে গিয়েছে। তা যে সব সময় সচেতন ভাবেই হয়েছে তা নয়। তবে এই দূরত্বকে রাজনীতি কাজে লাগায় পুরোদমে, ‘অপর’ নির্মাণের ক্ষেত্রে। গত কয়েক দশকে ভারতের রাজনীতি আর ধর্ম যেভাবে হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে, তাতে এই দূরত্ব আরও বেড়েছে বলেই আক্ষেপ করেন ইতিহাসবিদদের অনেকেই। গত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই বন্ধুদের জাগিয়ে সেই দেশকে জাগিয়ে রেখেছেন তিনি।
প্রায় ৫০ বছর। একই অভ্যাস। কোনোদিন ভুল হয়নি। মুসলিম বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেহরির জন্য জাগিয়ে দিয়ে আসে এক হিন্দু পরিবার। যোগীরাজ্যে খোঁজ এমনই এক সম্প্রীতির ভারতের।
আজমগড়ের ছোট্ট গ্রাম কৌড়িয়া। সেখানেই বাস গুলাব যাদবের। এই ক’টা দিন রাত গড়িয়ে একটা বাজলেই উঠে পড়েন তিনি। বারো বছরের ছেলেকে জাগিয়ে দেন। তারপর দু’জনে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। সঙ্গী বলতে হাতে একটা টর্চ। আর পথঘাটে কুকুরের বেশ উপদ্রব। তাদের ভয় দেখাতে সঙ্গে নেন একখানা ছড়ি। সেই নিশুতরাতে গ্রামের মুসলিমদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছন তাঁরা। তারপর তাঁদের জাগিয়ে তোলেন। যতক্ষণ না বাড়ির কেউ একজন সাড়া দিচ্ছেন, ততক্ষণ অন্যত্র পা বাড়ান না। কারণ একটাই, সেহরির জন্য তাঁরা যাতে জেগে ওঠেন। অবশ্য রোজদারের জন্য মসজিদ থেকে জাগিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে। তবে, বর্তমানে ধর্মস্থানে লাউডস্পিকারের ব্যবহার নিয়ে শীর্ষ আদালতের কিছু নির্দেশিকা আছে। এই আবহে যাদব পরিবারের এই কাজ যেন আরও প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আরও শুনুন: খ্যাপামি থেকে সাম্প্রদায়িক অশান্তি, উগ্র ভারতের ছক বুঝতে বারবার ভুল উদার দেশের?
অবশ্য যখন কোনোরকম বিধিনিষেধ ছিল না তখন থেকেই যাদব পরিবারের এই ব্রত। সেই ১৯৭৫ সাল। গুলাব যাদবের বাবা এই কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি প্রয়াত হওয়ার পর, গুলাব নিজেই এই কাজ করে চলেছেন। এখন সঙ্গী হয়েছে তাঁর ছেলে। শুধু যাদব পরিবারের ক্ষেত্রেই নয়, গ্রামের মুসলিমদের কাছেও এ যেন এক প্রথার মতো। গুলাবের মুসলিম প্রতিবেশীরা তাই বলেন, সেহরির আগে ‘যাদব ভাইয়ের’ ডাক শোনার অপেক্ষাতে থাকেন তাঁরা। এমনিতেই সেহরির জন্য কাউকে জাগিয়ে তোলা পরম কর্তব্য। সেই কাজটিই করে চলেছেন তাঁদের ‘যাদব ভাই’। শুধু জাগিয়ে দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হন না। ফিরতি পথে সকলের খাওয়া হয়েছে কি-না, সে খোঁজও নেন। বাবার হাত ধরে যে কাজ শুরু করেছিলেন গুলাব যাদব, আজও সে প্রথায় ছেদ পড়েনি। তাঁর বাবার পর, কিছুদিন তাঁর দাদা এই কাজ করেছিলেন। তার পর থেকে নিজেই এই দায়িত্ব নিয়েছেন। আর সেই দায়িত্ববোধের পাঠ দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সন্তানকে। মুসলিম প্রতিবেশীরা তাই বলছেন, যখন গীতা আর কোরান একযোগে ভালোবাসারই উপাসনার কথা বলছে, তাহলে হিন্দু-মুসলমানে দ্বন্দ্ব কেন থাকবে? রমজান মাস তাই এই গ্রামের কাছে সৌভাতৃত্বের উদযাপনও বটে।
আরও শুনুন: ‘ওদের উৎসব’ থেকে ‘আমাদের উৎসব’ রূপান্তরে জরুরি মন্দিরের রমজান-বার্তা
এই সম্প্রীতির ভারত যে হারিয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে আক্ষেপ করেন অনেকেই। দেশের সংখ্যাগুরুদের কাছে এখনও সংখ্যালগুদের পার্বণ ‘ওদের’ অনুষ্ঠান হয়েই থেকে গিয়েছে। তা যে সব সময় সচেতন ভাবেই হয়েছে তা নয়। তবে এই দূরত্বকে রাজনীতি কাজে লাগায় পুরোদমে, ‘অপর’ নির্মাণের ক্ষেত্রে। গত কয়েক দশকে ভারতের রাজনীতি আর ধর্ম যেভাবে হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে, তাতে এই দূরত্ব আরও বেড়েছে বলেই আক্ষেপ করেন ইতিহাসবিদদের অনেকেই। তাঁরা ভারতবর্ষের বৈচিত্রময় আত্মাটিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। তবে, শুধু তত্ত্বে তো হয় না। হওয়া সম্ভব এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মাধ্যমেই। যে যোগীরাজ্যে দোলের সময় মসজিদ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়, সেখানেই তো আছে গুলাব যাদবের ভারতও। গত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই বন্ধুদের জাগিয়ে সেই দেশকে জাগিয়ে রেখেছেন তিনি।
এতশত ভেবে তবেই কি এ-কাজ করেন গুলাব যাদব? মোটেও না। তিনি বলেন, ছোটবেলায় এ-কাজের অর্থ তিনি বুঝতেন না। বাবা ডাকতেন বলে সঙ্গ দিয়েছেন কেবল। তবে যত দিন গেছে অনুভব করেছেন যে, এই কাজে করে শান্তি পান তিনি।
উগ্র জাতীয়তাবোধ আর সাম্প্রদায়িক অশান্তির এই ডামাডোলে সেই শান্তিরই খোঁজ করছে বোধহয় গোটা দেশ।