সম্প্রীতি তো প্রদর্শনের পরাকাষ্ঠা মাত্র নয়। এবং এই ছোট ছোট পদক্ষেপেই থাকে সম্প্রীতি। সম্প্রদায়ের রীতিনীতি আলাদা হতে পারে, তবে একত্রে বসবাসের যে আর একরকম সাধারণ নিয়ম হতে পারে, সেই বড় জায়গাটেই পৌঁছে দেয় এই ধরনের পদক্ষেপ। অপরায়ণের রাজনীতি রুখে দিতে পারে সহাবস্থানের অবস্থান। মন্দিরের এই বার্তা যেন সেই কথাটিকেই নতুন করে বুঝিয়ে দিল।
সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া এক। আর তা অনুশীলনের মধ্যে নিয়ে আসা আর এক জিনিস। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ একত্রে বহুদিনই বসবাস করেন। তবু সংখ্যালঘুর পালা-পার্বণ কিছুতেই যেন সমগ্রের হয়ে উঠতে পারে না। এমন নয় যে, প্রতিবেশীর উৎসব সম্পর্কে সংখ্যাগুরুরা ওয়াকিবহাল নয়। তবে, সম্যক ওয়াকিবহাল, এমন কথা বলা যায় না। বস্তুত, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের পার্বণের মধ্যে যে সাদৃশ্য, অন্তর্গত যোগাযোগ তা সম্পর্কেও অনেকখানি উদাসীনতা চোখে পড়ে। অ্যাকাডেমিক পরিসরে অবশ্যই এ নিয়ে আলোচনা চলে। তবে গণমনে এ নিয়ে যে একরকমের সাংস্কৃতিক অনীহা ও উন্নাসিকতা যে রয়ে আছে, তা-ও অস্বীকার করা যায় না। অতএব দীর্ঘ সহাবস্থানের ইতিহাস নিয়েও ‘ওরা’ আর ‘আমরা’র বিভাজন আছেই। তার মাঝেই ভেসে আসে সম্প্রীতির বার্তা। কিন্তু বার্তা আর যাপন তো এক নয়। ফলত, সংখ্যালঘুর উৎসব কী করে সংখ্যাগুরুর তথা সমগ্রের উৎসবে পরিণত হবে, তা ভাবিয়েছে চিন্তকদের। এক্ষেত্রে পারস্পরিক যাপন, ও একে অন্যের সংস্কৃতির অনুশীলনের বিকল্প বোধহয় কিছু নেই। সে প্রক্রিয়ার রূপরেখা কী হতে পারে, তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আর তাই বলা চলে, এই মর্মে যে কোনও উদ্যোগই সংস্কৃতির পক্ষে স্বাস্থ্যকর।
:আরও শুনুন:
মায়ের কবরের পাশে বসে রমজান শুরু গাজার যুবকের
সেরকমই উদ্যোগ নিয়েছে দুবাইয়ের একটি মন্দির। শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। উপবাস এবং ইফতার। মুসলিমরা এই সময়টা উপবাস করেই কাটান। নির্দিষ্ট সময় পরে তাঁরা উপবাস ভঙ্গ করেন। সেই সময় কি সংখ্যাগুরুরা উপবাস করেন? বা মুসলিমদের সামনে খাওয়া থেকে বিরত থাকেন? উত্তর হল, না। কারণ, এই প্রথা ‘ওদের’, ‘আমাদের’ নয়, এই হল সাধারণ ধারণা। ধারণার এই বদ্ধমূলেই খানিক ঝাঁকুনি দিয়েছে দুবাইয়ের মন্দির কর্তৃপক্ষের বয়ান। সেখানে নোটিস দিয়ে জানানো হয়েছে, মন্দিরের ভিতরে প্রসাদ খাওয়া যেতে পারে। তা বাদ দিয়ে, মন্দিরে এবং মন্দির চত্বরে বা সংলগ্ন এলাকায় যেন খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকেন ভক্তরা। রমজানের শুভেচ্ছা জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি মন্দির কর্তৃপক্ষ; বা অন্য সম্প্রদায়ের উৎসব ও প্রথাকে সম্মান জানিয়েই নিজেদের দায়িত্ব সারেনি; বরং কীভাবে সম্মান জানানো যায়, নিজেদের যাপনশৈলীর সামান্য পরিবর্তন কীভাবে সম্মান-প্রদর্শন হয়ে উঠতে পারে, তা নমুনা হিসাবেও তুলে ধরতে চেয়েছে।
:আরও শুনুন:
বিমানবন্দরে বসেই নমাজ পাঠ! ‘মসজিদ পেয়েছেন নাকি?’ তোপ সহযাত্রীদের
এই বার্তার গুরুত্ব তাই অন্য মাত্রা পেয়েছে। সহাবস্থানের রীতি-নীতি কী হতে পারে, তার কোন স্থির-নির্দিষ্ট কাঠামো হতে পারে না। তবে, এক সম্প্রদায়ের মানুষকেই তা ঠিক করতে হবে যে, কীভাবে অন্য সম্প্রদায়কে অপর বা ওদের করে সরিয়ে না রেখে, সমগ্রের অংশ করে নেওয়া যায়। ধর্ম-রাজনীতির বিষ যখন সারা বিশ্বকেই গ্রাস করছে, তখন এই সহাবস্থানের কথা বারবার উঠে আসে। উঠে আসে সহমর্মিতা অনুশীলনের জায়গাটিও। তবে, তা তো নেহাত তাত্ত্বিক কথাবার্তা নয়। সম্প্রীতি তো প্রদর্শনের পরাকাষ্ঠা মাত্র নয়। এবরং এই ছোট ছোট পদক্ষেপেই থাকে সম্প্রীতি। সম্প্রদায়ের রীতিনীতি আলাদা হতে পারে, তবে একত্রে বসবাসের যে আর একরকম সাধারণ নিয়ম হতে পারে, সেই বড় জায়গাটেই পৌঁছে সেয় এই ধরনের পদক্ষেপ। অপরায়ণের রাজনীতি রুখে দিতে পারে সহাবস্থানের অবস্থান। মন্দিরের এই বার্তা যেন সেই কথাটিকেই নতুন করে বুঝিয়ে দিল।