দলিত আন্দোলনের ইতিহাসকেই পোশাকে ফিরিয়ে এনেছেন রাহুল। শাহের মন্তব্যের প্রতিবাদে পোশাকের রং হয়ে উঠেছে তাঁর হাতিয়ার। আর তাই এই প্রথম সাদা বা কালো ছেড়ে নীল রঙের টি-শার্টে দেখা গেল তাঁকে।
২০২২। ডিসেম্বর-জানুয়ারি। ভারত-জোড়ো-যাত্রায় রাহুল গান্ধী। পরনে সাদা টি-শার্ট। প্রশ্ন ধেয়ে এল, ঠান্ডা লাগছে না? রাহুলের তুরন্ত জবাব, এই দেশে কত মানুষেরই তো শীতে পরার মতো পর্যাপ্ত পোশাক নেই। কই তাঁদের তো এ-প্রশ্ন করা হয় না? তখন থেকেই তাঁর লুক আর পোশাকের নির্বাচন নিয়ে ইতিউতি কথা হত। ক্লিন শেভেন থেকে দাড়ি-গোঁফের লুকে একেবারে চমকে দিয়েছিলেন সকলকে। ঠিক যেন ‘ফকির আদমি’! রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তা নিয়ে চর্চাও করেছিলেন বিস্তর। আর সে সবের সার কথাটি এই যে, লুক তো বটেই, রাহুলের পোশাক নির্বাচন বেশ সুচিন্তিত। তা তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকেই চিনিয়ে দেয়। সেই রাহুল সাদা টি-শার্ট ছেড়ে এবার পরেছেন নীল রং। নেহাতই শখ? মোটেও না? পিছনে আছে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা। বলা যায়, দলিত বর্গের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেই সাদা ছেড়ে নীল পোশাক পরেছেন রাহুল।
তবে, সর্বদা সাদাই বা তিনি কেন পরতেন? একবার এর জবাবও দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, সাদা হল স্বচ্ছতা আর সাধারণত্বের প্রতীক। একই সঙ্গে বলিষ্ঠতার চিহ্ন। তাই সাদা রং তাঁর পছন্দের। খেয়াল করলে দেখা যাবে, কংগ্রেস তথা রাহুলের উপর ঠিক এই বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করেই আক্রমণ শানায় বিজেপি। রাহুলের পোশাকই যেন ছিল রাহুলের জবাব। সেই রাহুল যখন নীল টি-শার্ট ধরেছেন, তখন নেপথ্যে যে রাজনৈতিক বার্তা থাকবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সম্প্রতি আম্বেদকর-চর্চা যেভাবে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে, সেই প্রেক্ষিতেই এই পদক্ষেপ। বিতর্ক বেশ জমজমাট। দিনকয় আগে, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলে ফেলেন যে, এখন বারবার আম্বেদকরের নাম নেওয়া ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। এর থেকে বরং ভগবানের নাম নিলে সাত জন্মের জন্য স্বর্গবাস নিশ্চিত হত। এই নিয়েই সরব বিরোধীরা। আম্বেদকর এবং দলিতদের প্রতি বিজেপির মনোভাব যে কী, তা এই মন্তব্যে ফুটে উঠেছে বলেই মত তাঁদের। অন্যদিকে শাসকদলের চেনা ব্যাখ্যা যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। ঠিক এই রাজনৈতিক আবহেই রাহুলের গায়ে উঠল নীল শার্ট। রাহুল জানিয়েছেন যে, শাহের মন্তব্যের প্রতিবাদেই তিনি নীল-রঙা টি-শার্ট পরেছেন।
কিন্তু নীল রং-ই কেন দলিতদের প্রতি সংহতি প্রকাশের ভাষা হয়ে উঠল রাহুলের? এর নেপথ্যেও আছেন বাবাসাহেব আম্বেদকরই। জানা যায়, ব্যক্তিগত ভাবে নীল রং বেশ পছন্দ করতেন আম্বেদকর। তাঁকে নীল কোট পরতেও দেখা যেত। ভারতবর্ষের অন্ত্যজ শ্রেণির অধিকার আদায়ের লড়াইকে যেভাবে একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের রূপ দিয়েছিলেন আম্বেদকর, তাতে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের সঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস জড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে, এই রঙের তাৎপর্য শুধু সেখানেই আটকে নেই। ১৯৪২ আলে যখন সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন তৈরি করলেন আম্বেদকর, তখন প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়েছেন নীল রঙের পতাকা, সেখানে ছিল অশোকচক্রও। ক্রমে ক্রমে নীল রং দলিত বর্গের আত্মপরিচয় হয়ে ওঠে। তাঁদের অধিকার অর্জন, মর্জাদা, রাজনৈতিক অবস্থানের সূচক হয়ে ওঠে নীল রং। সেই সঙ্গে বাবাসাহেবের অনুষঙ্গ তো জড়িয়ে ছিলই।
এই ইতিহাসকেই পোশাকে ফিরিয়ে এনেছেন রাহুল। শাহের মন্তব্যের প্রতিবাদে পোশাকের রং হয়ে উঠেছে তাঁর হাতিয়ার। আর তাই এই প্রথম সাদা বা কালো ছেড়ে নীল রঙের টি-শার্টে দেখা গেল তাঁকে। এর আগে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে দেখা গিয়েছিল, ব্যাগের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। সেই ধারা আর একটু এগিয়ে নিয়ে গেলেন রাহুল। পোশাকের নীলে বুঝিয়ে দিলেন কত সূক্ষ্ম ও ব্যঞ্জনাবাহী হয়ে উঠতে পারে প্রতিবাদের ভাষা।