আফগান নারীরা যে দিনে দিনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, তা বিশ্বের অজানা নয়। তবু রাজনীতির যুক্তি ও প্রতিযুক্তি হয়তো নারী-নিরাপত্তাকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে নারাজ। এমনটাও মনে করছেন অনেকে। ফতোয়ার গড়ে জানালা তাই যেন বন্ধই ছিল। বিশ্বের দেখেও না-দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল আলোর চলাচল। এবার সেটুকুও বন্ধ হল, আক্ষরিক ভাবেই।
জানালাটুকু বন্ধ হল।
এ বুঝি একরকম আইরনিই! জানালার ফাঁকটুকু দিয়ে তালিবানি মহিলাদের গেরস্থালির কাজ করতে দেখে ফেললে, বেচাল হতে পারেন পুরুষরা। অতএব সেটুকু বন্ধ হওয়াই ভালো। তালিবানি মুখপাত্র এই ফতোয়া পোস্ট করেছেন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে। যে-প্ল্যাটফর্ম নাকি মুক্ত ভাবনা-চিন্তার পরিসরকে প্রশ্রয় দিতে পারে, সেখানেই বন্ধ গড়ের ডিক্রি জারি হল। বলা হয়েছে, সেই সব জানালাই একেবারে বন্ধ করে ফেলতে হবে, যা কিনা মহিলারা ব্যবহার করেন। বা যার মাধ্যমে ঘরের কাজে রত মহিলাদের দেখা যায়। ভবিষ্যতে বাড়ি তৈরি ক্ষেত্রে তা মাথায় রাখতে হবে। জানালাহীন নিরেট দেওয়াল হলেই হবে। আপাতত যে জানালা আছে তা বন্ধ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে।
তালিবানি ফতোয়ায় এটি একটি নয়া সংযোজন মাত্র। সম্ভবত, সে-দেশের মহিলাদের কাছে নতুন কিছু নয়। তিন বছর হল আবার নতুন করে শাসন কায়েম করেছে তালিবান। তার পর থেকে যেভাবে একে একে নারীদের স্বাভাবিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাতে হয়তো এই জানালাটুকুই একটুকু মুক্তির আকাশ হয়ে লেগে ছিল ফতোয়ার দেওয়ালে। সেটুকুও গেল। কিন্তু তাতে কী! সেই জানালা দিয়ে আদৌ কি তালিবান নারীদের দুরবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখছিল! পরপর ফতোয়ার খবর আসে, আলোচনা-চর্চা হয়। তাতে কি আফগানভূমে নারীদের অবস্থার সামান্যতম উন্নতিও হয়েছে? এক কথায় এর উত্তর, না। দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় পর্বেও তালিবান আছে তালিবানেই। আর সেই তালিবানি রক্তচক্ষুর জেরে সে-দেশের মহিলারা ক্রমশ অদৃশ্য, নির্বাক হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের অধিকার তো বটেই, এমনকী তাঁদের স্বরও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। একজন মানুষের পরিচিতির একেবারে যে মূল বিষয়গুলো, সেই জায়গাগুলো থেকেই তাঁদের অদৃশ্য করে দেওয়া হচ্ছে। নারীদের বাস্তবিকই নিশ্চিহ্ন বা ‘নেই’ করে তোলার এ যেন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যা আসলে একরকম নীরব হত্যা-প্রক্রিয়াই। বিশ্ব তা দেখছে। কিন্তু সেই স্বর ফিরিয়ে দিতে সেভাবে সরব হচ্ছে কই!
আরও শুনুন: ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার’, নারীরা সুরক্ষিত কোথায়? প্রশ্ন তুলল রাষ্ট্রপুঞ্জের নয়া সমীক্ষা
এই নিশ্চিহ্নকরণ যে সকলের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, তা নয়। রাষ্ট্রসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফগানিস্তানের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে গত তিন বছর ধরেই। নারীকে বন্দি করে রাখা এই বৈষম্যমূলক নিয়মকানুন তুলে দেওয়ার পক্ষে তারা সওয়াল করেছে। তবে, যথারীতি তালিবানি ঔদ্ধত্য সে সবে কর্ণপাত করেনি। কূটনৈতিক স্তরে বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারা এমন কোনও বড় পদক্ষেপ করেননি, এমন কোনও মন্তব্য করেননি, যাতে তালিবানের উপর চাপ বাড়ে। যত দিন গিয়েছে, তত যেন এই নাগপাশ থেকে মহিলাদের নিষ্কৃতীর আশাটুকুও ক্রমশ মরে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সব দেখেশুনে, এত উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও, কেন এই রাজনৈতিক নীরবতা? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছে, এখনই নতুন কোনও কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে হয়তো কেউই চাইছে না। ফলো, মানবাধিকার সংগঠনগুলো অনেক কিছু করতে চেয়েও পারে না। তাঁদের প্রতিবাদ-ই সার হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তাঁদের অভিমত, আফগানিস্তানের ভিতর থেকে যদি প্রতিবাদ ঘনিয়ে না ওঠে, তাহলে হয়তো সার্বিক পরিস্থিতি বদলাবে না।
আফগান নারীরা যে দিনে দিনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, তা বিশ্বের অজানা নয়। তবু রাজনীতির যুক্তি ও প্রতিযুক্তি হয়তো নারী-নিরাপত্তাকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে নারাজ। এমনটাও মনে করছেন অনেকে। ফলত যা চলছে, তাই-ই যেন একরকম স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে। আর এই নীরবতার সুযোগই নিচ্ছে তালিবান। নারীদের প্রতি তাঁদের স্বাভাবিক বিদ্বেষকে প্রতিষ্ঠানের কাঠামোয় এনে, নারীস্বরকেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে চলেছে তারা। এই পরিস্থিতি হয়তো একদিন বদলাবে। কিন্তু কবে? সে উত্তর এখনই কারা জানা নেই। জানা নেই বলেই মানবাধিকার সংগঠনগুলোও অসহায়।
ফতোয়ার গড়ে জানালা তাই যেন বন্ধই ছিল। বিশ্বের দেখেও না-দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল আলোর চলাচল। এবার সেটুকুও বন্ধ হল, আক্ষরিক ভাবেই।