নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক বলে রায় সুপ্রিম কোর্টের। কর্পোরেট চাঁদার চাপে যাতে মানুষের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না হয়, তার কারণেই রায়। তবে, ইতিমধ্যেই সব রাজনৈতিক দলগুলি এই বন্ডে অনুদান নিয়ে ফেলেছে। বন্ড চালুর পর একটা নির্বাচন হয়য়েও গিয়েছে, আসছে আর-একটা নির্বাচন। ঠিক এই সময়েই এল শীর্ষ আদালতের রায়। তা কতটা প্রভাব ফেলবে আগামী নির্বাচনে? দেশের ভবিষ্যতে? বিশ্লেষণে মণিশংকর চৌধুরী।
২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ২০২৪-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি। মাত্র বছকয়েক, এর মধ্যেই ফুরিয়ে গেল নির্বাচনী বন্ডের সাংবিধানিক আয়ু। সুপ্রিম রায়ের পর থেকেই এই নিয়ে দেশ জুড়ে তুমুল আলোচনা। ভারতীয় নির্বাচনের অনুদানের প্রক্রিয়ায় এই রায় বড় পরিবর্তন আনবে কি-না, তা ঘিরেই চলছে যাবতীয় জল্পনা।
নির্বাচনে অনুদান অবশ্য নতুন কিছু নয়। আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে যখন এই বন্ড চালু হয়, তখন এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সেই অনুদানের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা। অর্থাৎ নগদে চাঁদা নেওয়া যাতে বন্ধ হয়, এবং অনুদানের নামে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া যেন না চলে। এর মধ্যেই হয়ে গিয়েছে ২০১৯ নির্বাচন। এবং তথ্য বলছে, এই পরিসরে প্রায় সব রাজনৈতিক দলগুলিই বন্ডের মাধ্যমে অনুদান নিয়েছে। তার অঙ্কও নেহাত কম নয়। বন্ডের মাধ্যমে অনুদানের শর্ত ছিল যে, যে চাঁদা দিচ্ছেন আর যাকে চাঁদা দেওয়া হচ্ছে তা গোপন থাকবে, সেই সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষিত হবে চাঁদার অঙ্কেও। বিগত বছরগুলিতে এই পদ্ধতি চলেছে বেশ জোরকদমে। সাম্প্রতিক সুপ্রিম রায় অবশ্য যেন অন্য কথাই বলল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ যা রায় দিয়েছে, তার অস্যার্থ এই যে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া অনুদানের ভিত্তিতে আসলে কর্পোরেট সংস্থাগুলি নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই যথেচ্ছ প্রভাব বিস্তার করতে পারছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যে বিশ্বাস ও ভিত্তি থেকে একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দিচ্ছে এবং শাসকের ভূমিকায় আসীন করছে, সেই বিশ্বাসেরই হানি হচ্ছে। কেননা যে কর্পোরেট চাঁদা দিচ্ছে, তার মন রক্ষা করতে গিয়ে, জনস্বার্থ যে বিগ্নিত হতে পারে, এ খুব সহজ সমীকরণ। অতএব ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩-এর মধ্যে যে ১৬ হাজার, ৫০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়ে গিয়েছে, তাতে যে জনস্বার্থ লঙ্ঘিত হয়নি এমনটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। অর্থাৎ সংবিধানের ১৪-তম অনুচ্ছেদ যে সমানাধিকার দিয়েছে দেশের মানুষকে তা রক্ষিত হচ্ছে না। সেই হেতু অসাংবিধানিক বলে গণ্য হল নির্বাচনী বন্ড।
কোনও কোনও মহলে জল্পনা চলছে যে, এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করতে পারে কেন্দ্রের মোদি সরকার। আইনকে বরাবরই সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দিয়েছে মোদি সরকার, সাম্প্রতিক রামমন্দিরই তার বড় উদাহরণ। এক্ষেত্রেও তাই আইনের পথই অনুসরণ করা হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে, লোকসভা নির্বাচনের আর মাত্র কটা দিন বাকি। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলই ইতিমধ্যে নিজেদের ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে। প্রশ্ন হল, অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়ার আগে পর্যন্ত যে অনুদান নেওয়া হয়েছে, তা নাকচ হবে, এমন কোনও সম্ভাবনার কথা কিন্তু এখনও নেই। তাহলে তো গোতা ২০১৯-এর নির্বাচন এবং তার ভিত্তিতে আসা গণতান্ত্রিক সরকারকেই নাকচ করতে হয়। আর অনুদান না নেওয়ায় নির্দেশ লাগু হতে পারে, তবে, যদি আগের অনুদান নাকচ না হয়, তাহলে অধ্যাদেশ আনার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে করবে না রাজনৈতিক দলগুলি। তা ছাড়া এই বন্ডের সুবিধা যে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল নিয়েছে, তা তো নয়। একই পদ্ধতিতে চলেছে সব দলগুলিই। ফলত, এই ব্যাপারে খুব বেশি যে সোচ্চার হচ্ছেন বিজেপি বিরোধীরা, তা-ও কিন্তু নয়। অর্থাৎ নির্বাচনী বন্ড নিয়ে আগামীর পদক্ষেপ কী হতে পারে, তা নিয়ে খানিক ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।
তবে, ভারতীয় নির্বাচনের অনুদান সংক্রান্ত অস্বচ্ছতার ‘কোভিডে’ সুপ্রিম এই রায় হয়ে উঠতে পারে ‘ভ্যাকসিন’। কেননা এই রায় সরাসরি গণতন্ত্রের গোড়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। যেখানে আবার ফিরে আসছে সেই মূল কথা, দেশের প্রত্যেক মানুষ গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ। তাকা আর ক্ষমতার চাপে অর্থাৎ ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ঠেলায় যেন মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ না হয়, সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে শীর্ষ আদালত। বন্ড চালু হওয়ার পর ইতোমধ্যেই একটা ভোট হয়ে গিয়েছে; আর একটা ভোট আসতে চলেছে; ভবিষ্যতে কী হবে তা আগামী-ই জানে। তবু, কর্পোরেট চাঁদার খাতিরে মানুষের স্বার্থ যাতে ভেসে না যায়, তা নিয়ে যে নতুন করে আলোচনা শুরু হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকরই বলতে হবে।