সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তাতে স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি বেশ স্পষ্ট। ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে সকলেরই। একইভাবে আরও কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সমস্ত নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করে সংবিধান। তবে সুপ্রিম নির্দেশ বলছে ডিজিটাল অ্যাক্সেসও মৌলিক অধিকাররের মধ্যেই পড়ছে। বিষয়টা ঠিক কী? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
রোজের রুটিনটা একই রয়েছে। সকালে বেরোনো, সন্ধ্যায় ফেরা। সেই এক মেট্রো, অটো পেরিয়ে অফিস সফর। আশেপাশের পরিবেশটাও প্রায় এক। বদলেছে মানুষের চাহনি। চারপাশে যারা ছিলেন তাঁরা সকলেই রয়েছেন, কিন্তু কেউ তাকিয়ে দেখছেন না। দেখলেও চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন। এমন অভিজ্ঞতা কোনও একজনের নয়, বরং অনেকের। সমাজ এঁদের এভাবেই কেমন যেন আলাদা করে রেখেছে। তাতে অবশ্য এঁদের দোষ নেই। অথচ অবাক করার মতো বিষয়, যারা দোষী তারা বহাল তবিয়তে ঘুরলেও এঁদের নিয়ে যত সমস্যা।
কথা বলছি, অ্যাসিড আক্রান্তদের সম্পর্কে। সমাজ যাঁদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পায় না এখনও। সবাই যে এক এমন নয়। এঁদের জন্য এঁদের হয়ে এঁদের পাশে থেকে লড়াই করছেন, এমন মানুষও রয়েছেন। তবে বাকি যারা ‘সাতে পাঁচে থাকতে’ তেমন পছন্দ করেন না, তাঁরা এঁদের দেখলে চোখ নামিয়ে নেন। পরিচিত হলেও এমন একটা ভাব দেখান, যেন বুঝতেই পারেননি। তাতে সমস্যা নেই। নিজেদের মতো করে জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছেন এঁদের অনেকেই। সমস্যা অন্য জায়গায়, তা সামাজিক-অর্থনৈতিক দু-ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলছে। তাই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকেও। এ প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক এক রায় নিয়ে শুরু হয়েছে হইচই। বলা হচ্ছে, এই রায় ঐতিহাসিক। কিন্তু কেন? বিষয়টাই বা কী?
তাহলে খুলেই বলা যাক। বছর খানেক আগে অ্যাসিড আক্রান্ত এক তরুণী ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার সমস্যা নিয়ে মামলা করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, বিকৃত মুখ নিয়ে কেওয়াইসি করতে সমস্যা হচ্ছে। আর সেই কারণে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না। কিন্তু এই অপারগতায় তো তাঁর হাত নেই। তাঁর উপর হওয়া আক্রমণকে যদি দুর্ঘটনা বলা হয়, তাতেও তাঁর দোষ কোথায়? অথচ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁকেই। একে তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। আগের তুলনায় আমূল বদলেছে জীবন। সমাজ অন্য চোখে দেখা শুরু করেছে। সর্বত্র নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু কষ্টার্জিত টাকা ব্যাঙ্কে রাখতেও যদি সমস্যা হয়, তাহলে বিষয়টা নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে বইকি। বিষয়টা সুপ্রিম কোর্ট অবধি পৌঁছয়। সেখানেই বিচারপতির মন্তব্য, ডিজিটাল অ্যাক্সেস মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করতে হবে। অর্থাৎ বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অধিকারের মধ্যে অন্যতম হিসেবে দেখতে হবে এই ডিজিটাল অ্যাক্সেসকে।
ডিজিটাল ভারতের প্রতিশ্রুতি বর্তমান শাসকদল বহু আগেই শুনিয়েছে। সেইমতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের ডিজিটালাইজেশনের কাজও চলছে। দেশের অর্থনীতিতে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি, এমনটা বলাই যায়। ডিজিটাল কারেন্সি সম্পর্কে সকলেরই কমবেশি ধারণা আছে। পাড়ার মুদিখানা দোকান থেকে বড় বড় শপিং মল, সব জায়গাতেই ইউপিআই লেনদেন সম্ভব। এই নিয়ে রীতিমতো চর্চাও চলছে চারদিকে। তবে এসবের জন্য সবার আগে জরুরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। শুনে মনে হতে পারে, এ আর এমন কি ব্যাপার, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তো সকলেরই রয়েছে! বাস্তবটা এত সহজ নয়। চাইলেও অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন না এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। সাক্ষরতা প্রসঙ্গ এখানে টানা চলে না। কারণ নিরক্ষর ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট খুলবেন এই ব্যবস্থা যে কোনও ব্যাঙ্কেই রয়েছে। সমস্যাটা ‘কেওয়াইসি'(KYC) নিয়ে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘নো ইওর কাস্টমার’। অর্থাৎ গ্রাহকের পরিচয় জানা। এবং সেটা কীভাবে? অবশ্যই তাঁর ছবি তুলে বা আঙুলের ছাপ নিয়ে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী দেশের সমস্ত ব্যাঙ্ককে এই নিয়ম মানতে হবে। কেওয়াইসি ছাড়া কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন না। সমস্যা এখানেই। নিয়ম বলছে, স্রেফ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছবি তুললেই হবে না, একবার অন্তত চোখের পলক ফেলতে হবে। কিন্তু যাঁদের চোখের পলক নেই বা পলক ফেলতে অপারগ, তাঁরা? একথা শুনেও অবাক হতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু এমন মানুষ রয়েছেন। দৃষ্টিহীন বা চোখের গুরুতর সমস্যা থাকলে হতেই পারে এমনটা। কিংবা অ্যাসিডে যাঁদের মুখ ঝলসে গিয়েছে, আলাদা করে চোখের পাতা বলতে কিছু নেই, তাঁরাও এই দলে রয়েছেন। যিনি মামলা করেছিলেন তাঁর সমস্যাটাও এখানেই। চোখের পলক ফেলতে সমস্যা হওয়ায় বারবার কেওয়াইসি বাতিল হচ্ছিল তাঁর। তাতে অ্যাকাউন্ট খোলার মতো অতি প্রয়োজনীয় কাজটি আটকে যাচ্ছিল। এদিকে ব্যাঙ্কের তরফেও কিছু করার নেই, নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে কারও অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব নয়।
বাধ্য হয়েই মামলা করেন তরুণী। বিষয়টা নিয়ে সোশাল মিডিয়াতেও সরব হন। দীর্ঘদিন এই নিয়ে লড়াই চালাতে হয়েছে তাঁকে। অবশেষে সুপ্রিম নির্দেশে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেলেন। শীর্ষ আদালতের তরফে সাফ জানানো হয়েছে, ডিজিটাল অ্যাক্সেসের মতো বিষয়কেও মৌলিক অধিকারের মতোই দেখতে হবে। নির্দিষ্টভাবে কেওয়াইসির সমস্যা মেটাতে ২০টি উপায়ের কথা বলেছেন বিচারপতি। তাতে এই ধরনের সমস্যা অনেকটাই মেটানো সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ডিজিটাল অ্যাক্সেসের মতো অতি প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে এমন পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি ছিল বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তাই এই রায় ঐতিহাসিক রায়ের তকমা পেয়েছে। আসলে, এঁরা কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটান তা জানলে বা বুঝলেও, বদলানোর চেষ্টা করেন না কেউ। হয়তো সেই প্রয়োজনই মনে করেন না। তাই ডিজিটাল ক্ষেত্রে কে কতটা সুবিধা পাচ্ছেন বা আদৌ পাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে ভাবাও হয় না। শুধু অ্যাসিড আক্রান্তরাই নন, এই ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন আরও অনেকেই। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ কিংবা তথাকথিত শিক্ষিত নন, এমন কেউ অনায়াসে বাদ পড়ে যান। অথচ সংবিধান সেই অধিকার সবাইকে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট একথাই যেন মনে করিয়ে দিয়েছে। আলাদাভাবে বিষয়টাকে মৌলিক অধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা নয়। বরং সংবিধান যে স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলে, এ তারই অংশ। সুতরাং গোটা বিশ্ব যেখানে ডিজিটাল জগতকে আপন করে নিয়েছে, সেখানে এ দেশের সকলের শামিল হওয়ার অধিকার রয়েছে। ব্যাঙ্কের কাজ হোক বা অন্য কোনও বিষয়, স্রেফ ডিজিটাল জ্ঞান কম থাকায় তাতে অংশ নেওয়া যাবে না, এ ধারণা এবার বদলানোর কথা বলছে সুপ্রিম কোর্ট। বিষয়টাকে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ ডিজিটাল দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। কিন্তু বিষয়টা যদি মৌলিক অধিকার হয়, তাহলে এই ধরনের শব্দের প্রয়োজন ফুরোবে। হয়তো সকলের ক্ষেত্রে নিয়ম বা ধরণ এক হবে না। কিন্তু কেউ ডিজিটাল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন, এমনটা আর করা চলবে না। অন্তত সুপ্রিম নির্দেশিকা সে কথাই বোঝাল।